স্নেহাশিস সুর
যদি প্রশ্ন করা হয় আগামী দিনে পৃথিবীর সামনে সবচেয়ে বড় সম্যা কী— তাহলে যুদ্ধ বিগ্রহের কথা আসুক আর না আসুক— যে একটা বিষয় আসবে, তা হল জলবায়ু পরিবর্তন— আর সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী জলের তলায় হারিয়ে যাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়া প্রভৃতি। আসলে এই সমস্যা এখন আর অন্য দেশের সমস্যা নেই— এই সমস্যা এখন আমাদের ওপরেও এসে গেছে। আমরা এখনই এর ভুক্তভোগী হয়ে গেছি— ভবিষ্যতে এই সমস্যা আমাদের আরও ভোগাবে। দেখা যাক অবস্থাটা ইতিমধ্যেই কতটা ভয়াবহ হয়ে গেছে।
সম্প্রতি ভারতে বিজ্ঞান ও জলবায়ু নিয়ে কাজ করা অন্যতম অসরকারি প্রতিষ্ঠান— সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (সিএসই) সরকারি পরিসংখ্যান ও জনপরিসরে উপস্থিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে শুক্রবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে— যাতে আমাদের দেশের পরিস্থিতি ইতিমধ্যেই যে কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তা সামনে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান বছরের প্রথম নয় মাসে আবহাওয়ার চূড়ান্ত বিচ্যুতির ফলে যে মাত্রাতিরিক্ত খরা, বর্ষণ, শীত ও গরম দেখা দিয়েছে, তাতে ওই সময়ে সারা দেশে অন্ততঃ তিন হাজার দুশো জীবনহানী হয়েছে। এর মধ্যে আবহাওয়াজনিত বিপর্যয় বা দুর্যোগ—ঘূর্ণিঝড়, অতিবর্ষণ, বন্যা, খরা, ভূমিক্ষয়, ধ্বস প্রভৃতি রয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই সময়ে ৯৩ শতাংশ দিনে অর্থাৎ মোট ২৭৪ দিনের মধ্যে ২৫৫ দিনেই আবহাওয়ার চূড়ান্ত বিচ্যুতি হয়ে বিপর্যয়মূলক পরিস্থিতি তৈরি হয়।
বিষয়টা যে আর শুধু চিন্তার নয়— গভীর চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার কারণ বছরের পর বছর পরিস্থিতি ক্রমে ক্রমে আরও বেশি করে খারাপের দিকে যাচ্ছে। গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের প্রথম নয় মাসে ২৭৩ দিনের মধ্যে ২৫৫ দিন এবং তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের প্রথম নয় মাসে ২৪১ দিন আবহাওয়া স্বাভাবিকের থেকে চূড়ান্ত বিচ্যুত হয়ে বিপর্যয়মূলক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, জলবায়ুর চূড়ান্ত বিচ্যুতি ও তার থেকে উদ্ভূত বিপর্যয়ে প্রাণহানির পরিমাণ বিগত তিন বছরে ১৮ শতাংশ হারে বেড়েছে।
ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য ও পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে বর্তমান বছর (২০২৪) ইতিমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বহু রেকর্ড ভেঙেছে। যেমন এই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে সর্বোচ্চ ন্যূনতম তাপমাত্রা বিগত ১২৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল, যা উষ্ণায়নের এক মূর্ত প্রতিচ্ছবি। সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রার হিসেবে এ বছরের মে মাস ছিল চতুর্থ স্থানে। জুলাই, আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা সর্বকালীন রেকর্ড ছুঁয়েছে। আর বিগত অক্টোবর মাস গরমের দিক থেকে ১৯০৯ সালের পর রেকর্ড মাত্রা স্পর্শ করেছে।
আসলে আগে তাপমাত্রার পরিমাণ ১০০ বছরে একবার রেকর্ড স্পর্শ করত; আর এখন তা প্রায়ই হচ্ছে। ফলে এই ধরনের পরিস্থিতি প্রতিনিয়তই বিপর্যয় ডেকে আনছে— আর মানুষকে আরও বেশি করে সমস্যায় ফেলছে। ঝড় থেকে বজ্রপাত সবরকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশের সর্বত্র বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বাড়ছে এইসব দুর্যোগে প্রাণহানির সংখ্যাও। তাই পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত চিন্তার জায়গায় চলে গেছে। জরুরি হয়ে পড়েছে এর প্রতিকারের ব্যবস্থা করা। তার জন্য প্রয়োজন সচেতনতা, সঠিক নীতি প্রণয়ন, সেই নীতি অনুযায়ী কার্যকরী পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার সময়মতো সার্থক রূপায়ণ। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন বিপুল অর্থ।
আসলে এইসব কথা যে এখন উঠে আসছে তার কারণ, আগামীকাল থেকে আজারবাইজানের বাকুতে ফের হচ্ছে ২৯তম ‘কপ’ সম্মেলন। কপ-এর পুরো কথা ‘কনফারেন্স অফ পার্টিজ’। আসলে রাষ্ট্রসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে যে ইউএনএফসিসিসি— অর্থাৎ ‘ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ বলে যে সংস্থা আছে, এটি তার বার্ষিক সম্মেলন। যেসব দেশ এই সংস্থার অন্তর্গত তাদের পরিবেশ সংক্রান্ত নীতি নির্ধারকরা এই সম্মেলনে অংশ নেন। বহুদেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান বা পরিবেশ মন্ত্রীরাও এতে যোগ দেন— যোগ দেন দেশবিদেশের পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এবং জলবায়ু, পরিবেশ নিয়ে কাজ করছেন এমন অসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা।
ইউএনএফসিসি’র সূচনা হয় ১৯৯২ সালে রিও ডি জেনেরিও’তে অনুষ্ঠিত বিশ্ব আর্থ সামিট বা বিশ্ব ধরিত্রী শিখর সম্মেলনে। এই সম্মেলনেই প্রথম জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাকে চিহ্নিত করা হয় এবং এর ফলে যে সংকটের আশঙ্কা হচ্ছে তাকে মান্যতা দেওয়া হয়। বিভিন্ন দেশ এটি স্বীকার করার পর ১৯৯৪ সালে এই সংস্থা কাজ শুরু করে এবং ১৯৯৫ সালে জার্মানির বার্লিনে প্রথম ‘কপ’ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
কপ সম্মেলনগুলির মধ্যে প্রথম দিকে যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেটি ছিল তৃতীয় কপ বৈঠক বা কনফারেন্স অফ পার্টিজ-এর সম্মেলন। এটি অনুষ্ঠিত হয় জাপানের কিওটো শহরে। অংশগ্রহণকারী দেশগুলি এখানে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে— যেটি কিওটো প্রোটোকল নামে পরিচিত। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার প্রতিকারে বিভিন্ন দেশের, বিশেষত শিল্পোন্নত দেশগুলির কী করা উচিত, সেই বিষয় অংশগ্রহণকারী দেশগুলি চুক্তিবদ্ধ হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য এই চুক্তিকে মান্যতা দেয়নি। কিওটো চুক্তি কার্যকর হয় ২০০৫ সালে। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা নিয়ন্ত্রণের ভবিষ্যৎ রূপরেখা কী হবে, তা পরিষ্কার হয়ে যায়। তাই এই চুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম।
পরবর্তীকালে যে কপ সম্মেলন গুরুত্ব পায়, তা হলো ২১তম কপ বৈঠক, যা অনুষ্ঠিত হয় ২০১৫ সালে প্যারিসে। এইখানেই প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ঐতিহাসিক এই চুক্তিতে বিশ্বব্যাপী উষ্ণায়নকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা সম্ভব হলে প্রাক শিল্পোন্নয়ন যুগের ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে রাখার বিশ্বব্যাপী এক লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়। এই চুক্তিতে প্রতিটি দেশের নিজের স্বেচ্ছায় নির্ধারিত সহায়তা বা ন্যাশনাল ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন (এনডিসি) বিষয়টি উঠে আসে। এই প্যারিস চুক্তিই প্রথম পরিষ্কার করে বলে যে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলার জন্য পৃথক তহবিল গড়ার দরকার এবং এজন্য বছরে ১০০ মার্কিন ডলার সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়। এই অর্থ মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলিতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যবস্থা করার জন্য বিনিয়োগ করার কথা বলা হয়।
এর পরের কপ বৈঠকগুলির মধ্যে যেটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সেটি ২০২১ সালে গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ-এর ২৬তম অধিবেশন। এখানে পরিবেশজনিত যে ক্ষতি বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলিতে হয়েছে, তার অর্থাৎ ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ এবং জীবাশ্ম জ্বালানি মানে কয়লার ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করার কথা বলা হয়। এই বৈঠকে যে যে বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়, তার মধ্যে বিশ্ব উষ্ণায়ন তথা তাপমাত্রা বৃদ্ধির ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখার সিদ্ধান্তকে পুনরায় মান্যতা দেওয়া হয়। ২০৫০ সালের মধ্যে ক্ষতিকারক গ্যাস নির্গমন বন্ধ করার এবং বিশ্বব্যাপী কার্বন নিয়ন্ত্রণে প্যারিস চুক্তিতে গৃহীত বিষয়গুলি পুনরায় সুনির্দিষ্ট করা হয়।
গ্লাসগো সম্মেলনে ভারত কিছু অঙ্গীকার করে। এই সম্মেলনে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতের পক্ষ থেকে পাঁচটি বিষয়ের উল্লেখ করেন— যাকে তিনি নাম দেন ‘পঞ্চামৃত’। এগুলি হচ্ছে— ১) ভারত ২০৩০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম নয় এমন উৎস থেকে শক্তি উৎপাদনের পরিমাণ ৫০০ মেগাওয়াট করবে; ২) ২০৩০ সালের মধ্যে ভারত তার শক্তির চাহিদার অর্ধেক অচিরাচিরিত ও পুনর্নবীকরণযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করবে; ৩) ২০৩০ সালের মধ্যে ভারত কার্বন নির্গমনের পরিমাণ এক বিলিয়ন টন কমাবে; ৪) ২০৩০ সালের মধ্যে ভারত তার অর্থনৈতিক কার্যকলাপে কার্বনের প্রভাব ৪৫ শতাংশ কমাবে; ৫) ২০৭০-এর মধ্যে নেট জিরো মাত্রা অর্জন করার লক্ষমাত্রা রেখে এগোবে। নেট জিরো মানে ধরা যেতে পারে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ প্রায় পুরোটাই কমিয়ে ফেলা। ২০২১-এর মে গ্লাসগো সম্মেলনে নেওয়া অধিকাংশ লক্ষমাত্রার সময়সীমা যেহেতু ধার্য করা হয়েছে ২০৩০; তাই এখন সময় হয়েছে খতিয়ে দেখার যে, এই লক্ষমাত্রার দিকে অগ্রগতি হার কত। তবে এই লক্ষমাত্রাগুলি এই সংক্রান্ত ভারতের ঘোষিত পরিকল্পনা বা এনডিসি’তে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
কপ সম্মেলনের আলোচনায় যে যে বিষয় গুরুত্ব পায়, তার মধ্যে আছে বিশ্বজুড়ে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন এবং সারা বিশ্বে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হারকে গ্রহণযোগ্য মাত্রার মধ্যে নিয়ন্ত্রণে রাখা। বিপদসঙ্কুল দেশগুলি পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যার মোকাবিলা কীভাবে করবে, সেটা দেখা। এই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করা। পরিবেশজনিত সমস্যায় এর মধ্যে যে যে দেশে ক্ষতি হয়ে গেছে, সেই ক্ষতি অর্থাৎ যাকে এক্ষেত্রে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ বলা হয়, তার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা।
তবে আজারবাইজানের বাকুতে যে কপ কাল থেকে হতে চলেছে, সেখানে এই সমস্যার মোকাবিলা ও সমাধানে অর্থের ব্যবস্থা করার বিষয়টাই মূল প্রতিপাদ্য হয়ে উঠবে। তাই বাকুর কপ বৈঠক ইতিমধ্যেই ‘ফিনান্স কপ’ হিসেবে আখ্যা পেয়েছে বা চিহ্নিত হয়েছে।