বাংলাদেশ আশা করি আফগানিস্তান হবে না

প্রবীর মজুমদার

জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো শাসকই যে টিকতে পারেন না, বাংলাদেশে আবারও তা প্রমাণিত হলো। ২০০৯ সালে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসা শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিতে হলো অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে। এই প্রস্থান রাজনীতির জন্য একটি শিক্ষা। টানা সাড়ে ১৫ বছর তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ চালিয়েছেন ২০ বছরের বেশি সময়। ৪৩ বছরের বেশি সময় আওয়ামী লীগের সভাপতিত্ব করেন। তাঁর এই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কি একটিবারের জন্যও ভেবেছেন, তাঁর এরকম পরিণতি হবে? সম্ভবত না। রাজনীতি বোধহয় এমনই। রাজনীতির কিছু হিসাবনিকাশ অঙ্কের চেয়েও জটিল। কিন্তু আমরা যদি নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করি তা হলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারব পতন কেন শেখ হাসিনার হলো?

শেখ হাসিনার হাত ধরেই বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার এক নবযাত্রার সূচনা হয়েছিল। ইতিহাস নিশ্চয়ই তাঁকে মনে রাখবে। তাঁর হাত ধরে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, নানা উন্নয়ন স্থাপনাগুলো বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে কিছু ব্যাধি তাঁকে প্রচন্ডভাবে পেয়ে বসেছিল। তার মাশুল দিতে হলো শেখ হাসিনাকে। আওয়ামী লীগকে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা। এই সরকার গঠনের পর আন্তর্জাতিক মহল থেকে তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সরকার টিকে গেল এরকম একটি আত্মতুষ্টি এবং অহংকার পেয়ে বসে আওয়ামী লীগের সবাইকে। আর এই আত্মতুষ্টি এবং অতি অহংকারই আওয়ামী লীগের পতনের পথ। আমরা যদি নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করি কেন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটল? কেন শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে তছনছ হয়ে গেল শেখ হাসিনার ক্ষমতার দুর্গ তাহলে বেশ কয়েকটি কারণকে সামনে আনতে পারি। তবে সবচেয়ে বড় কারণ – জনবিচ্ছিন্নতা। আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। জনপ্রিয়তা নেমে গিয়েছিল শূন্যের কোঠায়। কিন্তু রাজনীতিতে এটি হলো নির্মম বাস্তবতা। একজন শাসককে কীভাবে দুর্নীতিবাজ, চাটুকাররা জনবিচ্ছিন্ন করে তার উদহারণ শেখ হাসিনা। এর ফলে জনবিচ্ছিন্ন শাসকের কি পরিণতি হয় তার উদহারণ ৫ আগস্ট।


যে কোনো স্বৈরতন্ত্র যখন গণআন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত হয়, তখন এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়। তার সুযোগ নেয় কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ। বাংলাদেশেও ঠিক তাই হয়েছে। শিক্ষার্থীদের এক দফা দাবি যেভাবে পূরণ হয়েছে, সেটা অভাবনীয়। ছাত্র-জনতা, তাই তাদের বিজয় এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান উদযাপন করছে। আচমকাই প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ এবং দেশ ছাড়ার খবর আসে। আন্দোলনকারীরা সেই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। সেনাবাহিনীও অপ্রস্তুত ছিল। শেখ হাসিনার পদত্যাগের ঠিক পরেই কয়েক ঘন্টা কার্যত কোনো আইনের শাসন ছিল না। দুর্ভাগ্যবশত সোমবার সন্ধ্যা থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিশেষত হিন্দুদের ওপর আক্রমণের খবর আসছে। অবশ্য একই সঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষার জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানও দেখা গেছে। সম্ভবত এরই পরিপ্রেক্ষিতে কিছু স্থানে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি, ধর্মীয় উপাসনালয় সুরক্ষায় শিক্ষার্থীসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের পাহারাও দেখা গেছে। অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব যাঁরা দিয়েছেন, তাঁরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার বিষয়ে উদ্যেগী হয়েছেন।

দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশে যে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা বা পট পরিবর্তনে বিভিন্ন ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষের ওপর, বিশেষত হিন্দুদের ওপর হামলা যেন প্রায় নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণাপুষ্ট জনগোষ্ঠীর দায় যেমন আছে, তেমনি রাষ্ট্রেরও দায় কম নয়। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত , সেদেশে এ ধরনের যত হামলা হয়েছে, তার একটিরও বিচার হয়নি। ফলে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির আস্ফালন দিন দিন বেড়েছে। সংখ্যালঘুর সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার কারণেই যে ওই অপশক্তি এমন দুর্বৃত্তপনার সুযোগ পায়, তা বলা বাহুল্য।

মুসলিম মৌলবাদের মাথাচাড়া দেওয়ার জন্যই বাংলাদেশের এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ যাবতীয় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে আওয়ামী লীগের একটি ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তারা এর বিপরীত কাজ করেছে। গোটা দেশ জুড়ে জমি দখল, বনাঞ্চল দখলের মত কাজ তারা করেছে। তিন ধরনের মানুষ গতকালের নৈরাজ্যে যুক্ত ছিলেন। প্রথমত, যাঁরা দীর্ঘদিন, বছরের পর বছর ধরে আওয়ামী লীগের দ্বারা অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। মার খেয়েছেন। তাঁরা পাল্টা মার দিতে গিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, সুযোগসন্ধানী মানুষজন, যাঁরা এই সুযোগে কিছু জমি বা সম্পদ হাতিয়ে নিতে চেয়েছেন। তৃতীয়ত, সাম্প্রদায়িক শক্তি, যারা পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘুদের আক্রমণ করেছে। আবার এটাও ঠিক যে গণঅভ্যুত্থানের বিজয়কে কলঙ্কিত করার জন্যও বেশ কিছু ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ভাঙার ঘৃণ্য কাজ গণঅভ্যুত্থানকে কলঙ্কিত করেছে।

এবারের অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল এটির অরাজনৈতিক চরিত্র। কোনো রাজনৈতিক দল এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়নি। আন্দোলনের প্রধান শক্তি ছিল ছাত্রসমাজ। তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন অভিভাবকরা, আইনজীবীরা, শিক্ষকসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ। এই অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক বাম জোট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি। এই অভ্যুত্থানের মূল আকাঙ্ক্ষা অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণ। সর্বজনের বাংলাদেশ নির্মাণ। সমস্যা হল, যে রাজনৈতিক দলগুলি এই আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে, তারা সাংগঠনিকভাবে দুর্বল। এই অবস্থায় অর্ন্তবর্তীকালীন জাতীয় সরকার যাতে গণঅভ্যুত্থানের এই আকাঙ্ক্ষার দিকে অগ্রসর হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার যাতে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণে ভূমিকা নেয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে।
নিশ্চয় সাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী লুঠপাট, সম্পদের কেন্দ্রীভবনের মত সমস্যাই বাংলাদেশের কাছে প্রধান চ্যালেঞ্জ। অনেক বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবীর মতে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা নির্মাণে আওয়ামী লীগের কোনো ভূমিকা নেই। তারা বরং মুক্তিযুদ্ধের যা ক্ষতি করেছে, তা আর কেউ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের নাম করে জনগণের উপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়েছে আওয়ামী লীগ। এর ফলে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আকর্ষণ কমেছে। আওয়ামী লীগের কারণেই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি জনগণের একাংশের বীতরাগ তৈরি হয়েছে।

আওয়ামী লীগ চলে গেলেই বিএনপি, জামাত চলে আসবে – এমন ভাবনা সঠিক নয়। জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক বিকল্প যে তৈরি হতে পারে, এই গণঅভ্যুত্থান তার প্রমাণ। আওয়ামী লীগের আমলে যা বিরোধিতা হয়েছে, প্রতিরোধ হয়েছে, সেখানে বিএনপি, জামাত কী ভূমিকা পালন করেছে? নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলন – জনগণই ছিল কেন্দ্রীয় ভূমিকায়। এবারের গণঅভ্যুত্থানেও তাই। বুকের রক্ত ঢেলে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ।  দেশ স্বাধীন করেছেন। তাই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকেই মুক্তিযুদ্ধকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জনগণের ভাবনায় আবার নিয়ে আসতে হবে।

জনগণের বিজয় প্রশ্নবিদ্ধ করতে উঠে পড়ে লেগেছে দুর্বৃত্তরা। সোমবার কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানের মাধ্যমে ছাত্র জনতার যে বিজয় অর্জিত হয়েছে তা নস্যাৎ করতে সমাজবিরোধীরা সহিংসতায় মেতে উঠেছে দেশজুড়ে। অন্ধকারের শক্তিগুলি বাংলাদেশের সমাজে আছে। কিন্তু তাদের সঙ্গে সামাজিক, রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক লড়াই অব্যাহত রাখা উচিত। তারা কখনোই জয়ী হতে পারবে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এই গণঅভ্যুত্থানের জন্ম দিয়েছে, সাফল্য অর্জন করেছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি কখনোই সেই সাফল্যকে গ্রাস করতে পারবে না। গণঅভ্যুত্থানের সাফল্যকে সংহত করে বাংলাদেশ আগামীর পথে এগোবে।

অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সাম্য মৈত্রী ও ঐক্য সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই সম্ভবত শান্তির সেই সমাজ গঠনের প্রত্যাশী। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীরা যেন কোনো অবস্থায়ই সুযোগ না পায়– তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সবার। এই সময়টায় বাংলাদেশ একটি রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এবারের ছাত্রদের জাগরণ আগামী প্রজন্মের প্রতি উজ্জ্বল বাংলাদেশের বার্তা দিচ্ছে। কেবল এই সময়েই নয়; সংখ্যালঘু ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অধিকার যেন সুরক্ষিত থাকে, সে জন্য সবসময় সোচ্চার হতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রতিবেশীদের দায়িত্ব সর্বাগ্রে। পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষের এমন সরকারের প্রয়োজন, যারা সংখ্যালঘুদের অধিকার ও সুরক্ষায় সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

বাংলাদেশ আজকের যে অগ্নিগর্ভ অস্থির সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে মানুষের ক্ষোভের বহুবিধ প্রকাশ হয়েছে, শত শত তরুণের প্রাণ নির্বাপণ করা হয়েছে এবং বহু অন্যায় সংঘটিত হয়েছে, তাতে বিচলিত হয়ে এবং সব বাংলাদেশির জন্য সেই অবস্থার একটি সুষ্ঠু ও স্থায়ী নিরসন প্রার্থনা করে। বাংলাদেশে শুভবুদ্ধির ও ন্যায়ের জয় হোক, বাংলাদেশের মানুষ ভালো থাকুন, এই কামনা আরও একবার করি। আশা করি বাংলাদেশ কোনোভাবেই আফগানিস্তানে পরিণত হবে না।