৯২ বছর বয়সে ৬৭ বছর আগের স্মৃতির রোমন্থন সহজসাধ্য নয়। অতীতের স্মৃতি মধুর হলে দীর্ঘজীবী হয়। তাই সাংবাদিকতা বিভাগের প্রারম্ভের কথা মনে পড়ে। যৌবন স্বপ্ন দেখায়। আর সেই স্বপ্ন ‘মানে না মানা’। দেশভাগ, পিতার কর্মস্থলে বদলি, পিতার হঠাৎ করে অসুস্থতা, শিলং শহরের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে আমাকে কলকাতা শহরের সমতলের এক বিস্তৃত পরিবেশে আবৃত করল। সে সব কথা গত শতকের পাঁচের দশকের কথা। কলকাতার আশুতোষ কলেজে পাঠ নিয়ে বিজ্ঞানে স্নাতক হলাম। শিলং শহরের বন্ধু তুষার, কমল ও দেবব্রতের সঙ্গে কবিতার কোরকের উন্মেষ হচ্ছিল। কলকাতায় আশুতোষ কলেজে এসে প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনায় শুরু হলো ‘হাঁটি হাঁটি পা-পা’। সঙ্গ হল লিটল ম্যাগাজিন ‘ইতিকথা’র সঙ্গে। সেই সঙ্গে কলেজের ছাত্র হয়েও সংগ্রামী মাধ্যমিক শিক্ষকদের আন্দোলনের সহমর্মী হয়ে গেলাম। তার জন্য দুটি পরিবেশজনিত কারণ এবং পরিস্থিতি-জনিত কারণ যুক্ত হয়ে আমাকে উদ্বেল করে তুলেছিল। সেটা ছিল ১৯৫৪ সাল। যে বাড়িতে তখন ছিলাম ভাড়াটে সেই বাড়ির অন্য ভাড়াটে ছিলেন জগদীশ রায়, সারেঙ্গাবাদ হাইস্কুলের সহকারী প্রধানশিক্ষক এবং শিক্ষক আন্দোলনে ছিলেন সক্রিয়। তার প্রভাবে আমি প্রভাবিত। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে পরিস্থিতিগত। আশুতোষ কলেজের লাগোয়া হাজরা পার্কে ছিল সংগ্রামী শিক্ষকদের ক্যাম্প অফিস। নিত্য যাতায়াতে এই ক্যাম্প আফিসই তৈরি করেছিল আমার মধ্যে আন্দোলনের উন্মাদনা। এই পটভূমিকাতেই আমারা শিক্ষকতাও শুরু।
আমার শিক্ষকতা পেশায় যোগদানের পরে দু’মাসের মধ্যে হঠাৎ করেই হয়ে গেলাম চব্বিশ পরগানা জেলার সদর মহকুমা সমিতির সম্পাদক। শিক্ষকতা ও সংগ্রামের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে আমি তখন খুঁজে বেড়াচ্ছি আমার কৈশোরের স্বপ্ন ‘লেখা’কে। তখন আমার নিত্য রুটিন কর্ম ছিল— স্কুলে যাওয়া, স্কুল ছুটির পরে কলেজ স্ট্রিটে শিক্ষক সমিতির অফিসে যাওয়া, সেখানে সংগ্রামের গন্ধ শুঁকে শুঁকে রাত্রে বাড়ি ফেরা। এটাই ছিল আমার উন্মাদনায় উদ্বেল জীবন। তার মধ্যে খুচ-খাচ চলছিল লেখা—কবিতা, আখ্যান, প্রবন্ধ আর নিবন্ধ।
এই সব নিত্যনৈমিত্রিক ঝরনার জলধারার মতো যখন বয়ে যাচ্ছিল তখনই ঘটল একটি ঘটনা। সেদিন প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে যখন পুরানো বই-এর দোকানগুলোর বই দেখে যাচ্ছি, তখন দেখা হলো আমার এক পুরানো বন্ধু অমলের সঙ্গে। অমল একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকার সম্পাদনা করতো। দেখা হলো, কথা হলো। যাদবপুরে থাকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যলয়ে এসেছে নতুন আরম্ভ হওয়া ‘স্নাতকোত্তর’ সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হবার নিয়মকানুন জানতে। ইদানিং পত্রিকায় এ বিষয়ে নাকি সংবাদ বের হয়েছে। যাইহোক পত্রিকার সেই সংবাদ আমার নজরেও আসেনি।
সাংবাদিকতা বিভাগ সম্বন্ধে সেই সংবাদকে পুঁজি করে, আর কালবিলম্ব না করে, আমিও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুসন্ধান অফিসে হাজির হলাম। জানতে চাইলাম নতুন খোলা এই সাংবাদিকতা বিভাগ সম্বন্ধে। জানলাম এই সাংবাদিকতার শিক্ষাক্রম দুই বছর মেয়াদের। তবে তা ডিগ্রি নয়, ডিপ্লোমা। ভর্তি চলছে। বিষদ বিবরণ জানা যাবে দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং-এর দ্বিতীয় তলের সেনেট হলের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে সাংবাদিকতা বিভাগের অফিস থেকে। সন্ধ্যা হয় হয় তখন। আমার আর তর সয় না। গুটি গুটি পায়ে, সুন্দর সিঁড়িগুলো যেন নিমেষেই ভেঙে, দোতলার সেনেট হলে উপস্থিত হলাম। সেনেট হলে ঢুকেই পশ্চিম দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম একজনকে। তাঁর টেবিল-চেয়ার বেশ গোছানো। পেছনে গোটা দুই তিন আলমারি। ধীরে তাঁর দিকে এগিয়ে যেতেই, জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী চাই?’ আমি বললাম, ‘এটা কি সাংবাদিকতা বিভাগের অফিস?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, বলুন’। ভারি মিষ্ট সম্ভাষণ, অবাক হবার মতো। তখনও তাঁর নাম জানি না।’ পরে নাম জেনেছিলাম— দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নাম। আমি বললাম— ‘আমি ভর্তি হতে চাই।’ তিনি আমার যোগ্যতা জানতে চাইলেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে তা জানালাম। তিনি জানতে চাইলেন লেখার অভ্যেস আছে কিনা। আমি বললাম লেখার অল্প অভ্যাস আছে। কিছু লেখা প্রকাশিতও হয়েছে লিটল ম্যাগাজিনে, একটা লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনাও করেছি এক সময়। এখন শিক্ষকতা করি। ভবিষ্যতে সাংবাদিকতা করতে চাই। তিনি স্মিত হাস্যসহকারে বললেন, ‘ভালো কথা’। আমি জানতে চাইলাম, ভর্তি হতে গেল আমাকে কী করতে হবে? উত্তরে তিনি বললেন— ‘একটি ভর্তির ফর্ম নিয়ে যান। ফর্ম পূরণ করে, সব সার্টিফিকেটের কপি সঙ্গে যুক্ত করে টাকা পয়সা নিয়ে কালকে চলে আসুন।’ ‘চলে আসুন’ কথাটির মধ্যে মধু মাখা। আমি উদ্যোগী হয়ে এসেছি। তবে এমন অভ্যর্থনা যে পাব তা স্বপ্নেও ভাবিনি। মনে ভেসে উঠেছিল একটা কবিতা— ‘কত অজানাকে জানাইলে তুমি/ কত ঘরে দিলে ঠাঁই/ দূরকে করিলে আপন বন্ধু,/ পরকে করিলে ভাই।’ সাংবাদিকতা বিভাগের অফিস অধ্যক্ষ দ্বিজেনবাবু অচেনা ছিলেন, চেনা হলেন, ‘ঠাঁই’ দিলেন আমাকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে ছাত্র হিসাবে ভর্তি হওয়া যে এত সহজ হবে তা কল্পনাতেও কখনও ভাবিনি। সম্ভবত তার কারণ হতে পারে বিভাগটি নতুন খোলা হয়েছে, কারণ হতে পারে তত প্রচার হয়নি বলে হবু ছাত্র-ছাত্রীরা খোঁজ খবর নেওয়ার মতো গরজ করছে না। তৃতীয়ত, সাংবাদিকতা পেশা শ্রমসাধ্য এবং মেধাসাধ্য— খুব অল্প সংখ্যক মানুষেরই সেই রিস্ক নেওয়ার মতো মুরদ আছে। দ্বিজেনবাবুর মুখে হাসি লেগেই আছে। এই সদাহাস্যময় মানুষটি একাই সাংবাদিকতা দপ্তরের অফিস সামলাচ্ছেন। বুকের পাটা না থাকলে এমন গুরুদায়িত্ব বহন করা সহজ নয়। যাই হোক, ফর্ম নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। পরের দিন সব কাগজপত্র নিয়ে ঠিক সময় সাংবাদিকতা বিভাগের দপ্তর-প্রধান দিজেনবাবুর সামনে উপস্থিত হলাম। তিনি সব কাগজপত্র দেখলেন। বললেন, সব কাগজপত্র ঠিকঠাক আছে— আপনিতো শিক্ষক তাই সব কিছু ঠিক। যতদূর মনে আছে এই হচ্ছে আমার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তির ইতিকথা। সেটা ১৯৫৮ সাল। তখন আমার বয়স ২৪ বছর। যথাসময়ে ক্লাস শুরু হল। তারিখটা মনে নেই। তবে মনে আছে আশুতোষ বিল্ডিং-এর দ্বিতীয় তলের একটি প্রশস্ত ক্লাসরুমে আমাদের প্রথম দিনের প্রথম ক্লাস হয়েছিল। ক্লাস নিয়েছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ। বর্ষিয়ান খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। বহুদিন ‘বসুমতী’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। দ্বিজেনবাবু রোল কলের খাতা হাতে নিয়ে হেমেন্দ্র প্রসাদ ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে, শ্রেণিকক্ষে ঢুকলেন। বললেন ‘স্যার আপনি চেয়ারে বসুন, আমি ছাত্র-ছাত্রীদের বসাচ্ছি।’ এই বলে সব ছাত্র-ছাত্রীদের ডেকে ডেকে শ্রেণি কক্ষে একে, একে বসালেন। বললেন, ‘ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই বসেছে। আমার কাজ শেষ হলো। আমি চললাম আমার অফিসে।’ এই বলে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে গেলেন দ্বিজেনবাবু।
আশুতোষ বিল্ডিং-এর শ্রেণিকক্ষে সেই আমার প্রথম প্রবেশ। ক্লাসরুমের দক্ষিণ দিকে উঁচু প্লাটফর্মে চেয়ারে বসে আছেন স্যার। স্যার মানে বিখ্যাত সাংবাদিক হেমেন্দ্র প্রসাদ ঘোষ। তাঁর সামনে টেবিল। তাঁর প্রথম বাক্তব্যটি ছিল, ‘আজ এক শুভদিন। আজ সকলে মিলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ বিল্ডিং-এর এই শ্রেণিকক্ষে সাংবাদিকতা বিষয়ে উচ্চশিক্ষার পঠন-পাঠন এবং গবেষণার সূচনা হলো। আজকের এই ঐতিহাসিক দিনের সাক্ষী হয়ে রইলাম আমরা সকলে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে, বলতে গেলে, সারা জীবন ধরেই সাংবাদিকতা করেছি। তাতে পেয়েছি আনন্দ, পেয়েছি তৃপ্তি। আমি আশা করবো, তোমরা সবাই সাংবাদিকতার শিক্ষাগ্রহণ শেষ করে সাংবাদিকতাকে পেশা করে নেবে। জেনে রাখো সাংবাদিকতায় নিয়োজিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে দেশসেবা করা— মানবতার সেবা করা। তাঁর বক্তব্য উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের আবেগে উদ্বেলিত করে। সকলেই হাততালি দিয়ে স্যারকে শ্রদ্ধায় আপ্লুত করে। একজন ছাত্র দাঁড়িয়ে বলে, ‘স্যার, আপনাকে দেখে আজ আমরা এমনিতেই অভিভূত। আপনার বক্তব্য শুনে আমরা উৎসাহিত বোধ করছি। আপনি আমাদের আশীর্বাদ করবেন যাতে আমরা আপনার ছাত্র হিসেবে সার্থক সাংবাদিক হতে পারি। এরপরে স্যার ‘রোল কল’ শুরু করে প্রত্যেক ছাত্রের পরিচয় জেনে নিলেন। আমার পরিচয় দিতে গিয়ে জানাই যে আমি একজন শিক্ষক এবং শিক্ষক সমিতির একজন মহকুমাস্তরের নেতা— চব্বিশ পরগনা মহকুমা সমিতির সম্পাদক। স্যার এইসব শুনে বললেন, ‘শিক্ষকতা ছেড়ো না, কিন্তু তার সঙ্গে সাংবাদিকতাও চালিয়ে যাবে।’ এই হচ্ছে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার স্বপ্নময় আলেখ্য। এইসব বাক্য বিনিময়ের মধ্যেই একজন রুটিন জানিয়ে গেলেন। কবে কোন ক্লাসরুমে আমাদের কোন বিষয়ের ক্লাস হবে, তা জানিয়ে গেলেন। প্রথম দিনের ক্লাস এভাবেই শেষ হয়েছিল। এই মধুর স্মৃতি আজও আমার স্মৃতির গহীনে বিরাজমান। আমার মতো ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতিতেই জন্ম নিয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ, সেই ১৯৫৮ সালে।
পরের দিনের ক্লাসে যথাসময়ে উপস্থিত হলাম। সেদিন ক্লাস নিয়েছিলেন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ এবং তাত্ত্বিক অধ্যাপক মোহিত মৈত্র। একজন রাজনৈতিক নেতার পরিচয় মেলে তাঁর জনসভার ভাষণে বা পথসভায়। কিন্তু কোনও শিক্ষাকেন্দ্রে তাঁর অধ্যাপনা, এক অনন্য ঘটনা। লক্ষে এক। গত শতকের পাঁচের দশকে মোহিত মৈত্র, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য নাম। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির একজন বড় নেতা। লোকসভায় তিনি কলকাতার উত্তর-পশ্চিম কেন্দ্র থেকে ছিলেন একজন নির্বাচিত সদস্য। কেবল তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের সংযুক্তিকরণের যে কেন্দ্রীয় পদক্ষেপ, তাকে স্তব্ধ করার জন্য যে বিরাট গণআন্দোলন পশ্চিমবঙ্গকে উত্তপ্ত করেছিল— তার অন্যতম প্রধান হোতা ছিলেন মোহিত মৈত্র। তাঁর চেহারা, পোশাক, চলার মধ্যে প্রকাশ পেত এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর মাথার পক্ক কেশ উল্টো দিকে আঁচড়ানো। গায়ে এক রঙের পাঞ্জাবী। পরনে কোঁচা ঝোলানো ধুতি। পায়ে স্যান্ডেল, চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা, মুখে চুরুট। এই দুর্লভ ব্যক্তিত্বকে আমি প্রথম দেখি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথের সামনে। তিনি আসছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের দিক থেকে মৃদুমন্দ পদচারণায়। একজন হকার, আমাদের সতর্ক করে বললেন, ‘একটু সরে দাঁড়ান, মোহিত মৈত্র আসছেন’। এইভাবে, যাঁকে নামে চিনতাম, যাঁর ছবি পত্রিকায় দেখেছি, ‘তাঁকে দেখলাম। তারপরে তো ক্লাসেই পরিচয় হল। জলদগম্ভীর কণ্ঠ। ক্লাসে তাঁর প্রথম বক্তব্য ছিল, ‘তোমরা সাংবাদিকতায় শিক্ষা নিতে এসেছো, আমি তোমাদের সহায়ক। সর্বদা মানুষের কথা শুনবে, মানুষের পাশে থাকবে, সর্বদা মানুষের কথা লিখবে। এই বিষয়টি রপ্ত করবে এই সাংবাদিকতা পাঠ্যাভাসের মাধ্যমে। কি? পারবে তো?’ ছাত্র-ছাত্রীরা একবাক্যে বলে উঠেছিল— ‘হ্যাঁ স্যার, আমরা সেই জন্যেই এসেছি।’ এরপরে বিজ্ঞাপন কি, বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য কী এবং কীভাবে বিজ্ঞাপন তৈরি করতে হয় সে সম্বন্ধে দীর্ঘ আলোচনায় মগ্ন হয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে তাঁর মগ্নতা ভাঙলো। তাঁর বাঁ-পাশের বেঞ্চের দ্বিতীয় সারিতে বসা বরুণ সেনগুপ্তকে দেখে। অঙ্গুলি নির্দেশ করে বরুণ সেনগুপ্তকে দাঁড়াতে বললেন। তারপরে বললেন ‘তুমিতো এই ক্লাসের ছাত্র নও। কার অনুমতি নিয়ে তুমি ক্লাসে ঢুকেছো এবং বসেছ?’ বরুণ সেনগুপ্ত উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমি আপনার পড়ানো শুনতে এসেছি।’ স্যার বললেন, ‘এভাবে কোনও ক্লাসে ঢোকা যায় না, বসা যায় না। এক্ষুনি ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাও।’
বরুণ সেনগুপ্তের নাম আমার শোনা। আনন্দবাজার পত্রিকায় মাঝে মাঝে লেখেন। ভালোই লেখেন। পরে ‘বর্তমান’ পত্রিকার সম্পাদক হয়ে পত্রিকাটিতে নবযুগ এনেছিলেন। আজকে যখন ভাবি সেই পুরানো দিনের কথা তখন মনে হয় বরুণ সেনগুপ্ত কেন যে কোনও অনুমতি না নিয়ে মোহিত স্যারের ক্লাসে ঢুকেছিলেন কে জানে? এমন ঘটনা অনভিপ্রেত।
এবারে বলি ধীরে ধীরে মোহিত মৈত্রের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, শিক্ষক আন্দোলনের চর্চায়। আমাদের শিক্ষক সমিতি বাটানগরে একটি জনসভা ডেকেছিল। শিক্ষকদের দাবি দাওয়া নিয়ে। আমি স্যারকে অনুরোধ করেছিলাম সেই সভায় সভাপতিত্ব করার জন্য। তিনি রাজি হয়েছিলেন। সেই সভার প্রধান অতিথি ছিলেন বাটানগর মজদুর ইউনিয়নের সভাপতি সুধীর ভাণ্ডারি। সুধীর ভাণ্ডারি ছিলেন একজন বলিষ্ঠ শ্রমিক নেতা, ওয়ার্কার্স পার্টিরও নেতা। তাঁদের অফিস মির্জাপুর স্ট্রিটে। যা হোক স্যারকে নিয়ে যাওয়ায় জনসভার আয়তন অনেক বেড়ে গিয়েছিল। স্যারের বক্তব্য ও সুধীর ভাণ্ডারির বক্তব্যে বারে বারে ৫৪ সালের ঐতিহাসিক শিক্ষক আন্দোলনের কথা উঠে এসেছিল। সভার শেষে স্যারকে বাটানগর স্টেশনে রেলগাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছিলাম। প্ল্যাটফর্মে শিক্ষক আন্দোলন নিয়ে আলোচনার সময়ে তিনি শিক্ষক নেতা সত্যপ্রিয় রায় সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন ‘A mine of informations’। তাঁর এই উক্তির কথা আজও আমার মনে আছে।
পরের দিনের পত্রিকায় আমার প্রেরিত বিবরণ ছাপা হয়েছিল। এই রিপোর্ট নিয়ে আমাদের সাংবাদিকতার ক্লাস ছিল সরগরম। পরের দিনের ক্লাস ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিখ্যাত অধ্যাপক ধীরেন সেনের। তিনি ক্লাস নিতেন আশুতোষ বিল্ডিং-এর দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ক্লাস ঘরে। সেদিন তিনি বক্তব্য রাখছিলেন ‘দেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং সাংবাদিকের দায়’ নিয়ে। তারিখটি মনে আছে ১৯৫৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। এই দিন জাতীয় নেতা মৌলানা আবুল কালাম আজাদ পরলোকগমন করেছিলেন। অধ্যাপক সেনের বক্তব্য রাখার মাঝখানেই ছাত্র পরিমল পাঠক উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘স্যার একটি দুঃসংবাদ আছে। বলব কি স্যার? স্যার বললেন, ‘বল কি দুঃসংবাদ বল?’ পরিমল বলল, ‘স্যার-কংগ্রেস সভাপতি মৌলানা আবুল কালাম আজাদ আজ পরলোকগমন করেছেন। রেডিও শুনেছি।’ অধ্যাপক ধীরেন সেন মন দিয়ে সংবাদটি শুনলেন। তারপরে বললেন, ‘দেখ, মৃত্যুতে কোনও কিছুই পরিসমাপ্তি হয় না, হয় রূপান্তর মাত্র। গাছের পাতায়, নানা ফুলে, নানা জীবের মধ্যে তার নতুন অবস্থান। হয়তো কোনও মানুষ রূপেই তিনি নবরূপ নেবেন। জীবন হচ্ছে মহাজীবনেরই অংশ। নানা কাজে, নানা বাণীতে তিনি মানুষের স্মৃতিতে সদাজাগ্রত আছেন ও থাকবেন। আমার ছাত্ররা, তোমরা কি বুঝতে পারছো আমি কি বলছি? মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।’ স্যারের বক্তব্য শুনে আমাদের মনের শোকভাব অনেকটাই প্রশমিত হলো। তারপরে স্যারের কথায় সকলেই দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করে মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে শ্রদ্ধা জানালাম। স্যার বললেন, ‘পরের দিন ক্লাসে আলোচনার বিষয় হবে মৌলানা আজাদের জীবনকৃতি সাংবাদিকতার দৃষ্টিভঙ্গি।’ এই বলে ক্লাস শেষ করলেন স্যার ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৮ তারিখে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
ক্লাসের শেষে মনে হলো একবার দ্বিজেনবাবুর সঙ্গে দেখা করে যাই। তাই সেনেট হলের দিকে এাগোলাম। সেনেট হলে ঢুকে দ্বিজেনবাবুর টেবিলের দিকে এগুতেই দেখি একজন বয়স্ক মানুষের সঙ্গে দ্বিজেনবাবু কথা বলছেন। দ্বিজেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘চেনেন কি, ইনি কে?’ আমি বললাম ‘না।’ দ্বিজেনবাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন—‘ইনি হচ্ছেন চপলাকান্ত ভট্টাচার্য’ আমি বললাম, ‘আর বলতে হবে না’। তিনি আনন্দবাজার পত্রিকার খ্যাতিমান সম্পাদক— ভারত বিখ্যাত মানুষ’ এই বলে তাঁকে প্রণাম করলাম। দ্বিজেনবাবু আমার পরিচয় জানালেন। চপলাকান্ত বললেন, একথা ঠিক যে, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ‘ডিন’। আমার আরও সময় দেওয়া উচিৎ। কিন্তু লোকসভার সদস্য হয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। তবু দেখি সময় দিতে পারি কি না। কথা ফুরাবার আগেই এসে হাজির হলেন আর একজন বড় সাংবাদিক, প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়ার অন্যতম কর্তাব্যক্তি বিধুভূষণ সেনগুপ্ত। বিধুভূষণ সেনগুপ্তকেও মাঝেমাঝেই দেখি সাংবাদিকতা বিভাগে। আমাদের ক্লাসের অন্যতম ছাত্র পরিমল ভট্টাচার্য কয়েকদিন আগে আমার সঙ্গে বিধুভূষণ সেনগুপ্তের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তখন বিধুভূষণ আমাকে বলেছিলেন— ‘আমরা খবর সংগ্রহ করি, আবার খবর বিতরণ করি।’ ১৯৫৮ থেকে দু’বছর টানা শিক্ষাক্রমের ইতিবৃত্ত জেলার নয়। স্মৃতিতে সেসব দোদুল্যমান আজও।