বাংলা গদ্যের ইতিবৃত্ত

সাধারণভাবে ভাষা বলতে আমরা বুঝি মুখে উচ্চারিত শব্দের সাহায্যে মনের ভাব প্রকাশ। অবশ্য একটু ব্যাপক অর্থে দেখলে ভাষাকে বলা চলে ভাব প্রকাশের একটা সংকেত। সে সংকেত নানা রকমের হতে পারে; সব সময়ে শব্দের সাহায্য নিতে হবে এমন নয়। নিঃশব্দে, আকার ইঙ্গিতে, ভাবে ভঙ্গিতেই অনেক কথা বলা যায়। বোবারও ভাষা আছে; হাত পা নেড়েই সে অনেক কথা বুঝিয়ে দিতে পারে। এ ছাড়াও ভাব প্রকাশের নানাবিধ উপায় আছে। চিত্রকর তাঁর মনের ভাব প্রকাশ করেন রেখা এবং রং-এর সাহায্যে। রেখা এবং রং-ই তাঁর ভাষা। সংগীতশিল্পী ভাব প্রকাশ করেন সুরে লয়ে তানে। সুরই তাঁর ভাষা। কথার সাহায্য ইচ্ছা হয় নেন, না হয় তো নেন না। হর্ষ বিষাদ, বিরহ মিলন, প্রেম ভক্তি—সবই সুরের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সিনেমা সবাক হল এই সেদিন। নির্বাক ছবি দেখেই জগৎ মুগ্ধ ছিল বহুকাল। নির্বাক ভাষা বুঝতেও কিছু কষ্ট হয়নি।

তাহলেও স্বীকার করতেই হবে, ভাষার ব্যবহার মুখ্যত মুখের কথায়। আবার মনে রাখতে হবে, মুখে উচ্চারিত শব্দমাত্রই ভাষা নয়। সকল জীবের কণ্ঠেই শব্দ আছে কিন্তু ভাষা নেই। ভাষা একমাত্র মানুষের মুখেই আছে এবং সে-ভাষা মানুষের নিজের সৃষ্টি, বিধাতার দান নয়। অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে এখানেই মানুষের তফাত। জীবজন্তু সকল ব্যাপারেই একান্তভাবে প্রকৃতির মুখাপেক্ষী। মানুষ তা নয়, সে নিজের প্রয়োজন নিজেই মিটিয়ে নেয়। সকল জীবই গাত্রাবরণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, একমাত্র মানুষই ভূমিষ্ঠ হয় নিরাবরণ দেহে। অন্য কোন জীব খাদ্য উৎপাদন করে না, প্রকৃতির ভাণ্ডারে যা ছড়িয়ে আছে তাই দিয়েই উদরপূর্তি করে। আশ্রয়ও প্রকৃতির কোলে—মাটির গর্তেষ বৃক্ষকোটরে গুহাগহ্বরে। মানুষনিজের গাত্রাচ্ছাদন নিজে তৈরি করে নিয়েছে, নিজ খাদ্যের প্রতিটি কণা নিজে উৎপাদন করে নিয়েছে। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুর ব্যবস্থাও নিজের হাতেই করতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বড় সন্দর করে বলেছেন, মানুষকে সর্বপ্রকারে বঞ্চিত করে বিধাতা মানুষকে অশেষ সম্মান দেখিয়েছেন। বলতে চেয়েছন, ওকে কিছু দিতে হবে না, সে নিজ বুদ্ধিতে নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নেবে।

দেহের প্রয়োজন মেটাবার সঙ্গে সঙ্গে মনের ভাষাও তৈরি হয়েছে। কেননা মানুষের ভাষা তার প্রয়োজনের মাপে তৈরি। সেই সুদূর অতীতে মানুষের প্রথম ঘরকন্না ছিল যৎসামান্য উপকরণে গড়া। (ক্রমশ)