• facebook
  • twitter
Saturday, 4 January, 2025

বাংলা গদ্যের ইতিবৃত্ত

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছোকরা সাহেবরা সদ্য বিলেত থেকে এসে অথৈ জলে পড়ে। দেশের ভাষা জানে না বলে কাজ চালানো এদের পক্ষে কঠিন হয়ে ওঠে।

ফাইল চিত্র

হীরেন্দ্রনাথ দত্ত

পূর্ব প্রকাশিতর পর

ইংরেজদের আমলে তেমনি আপিস-আদালতের ভাষা হল ইংরেজি। কাজেই এখন আবার ইংরেজি শেকার ধূম পড়ে গেল। শুধু চাকরির উমেদাররাই নয়, দেশীয় ব্যবসাদাররাও ভাবলেন, ইংরেজি শিখে নিতেপারলে ইংরেজের সঙ্গে ব্যবসার ব্যাপারে সুবিধে হবে। খুব স্বাভাবিক কারণেই দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় ইংরেজির দিকে ঝুঁকলেন; ধীরে ধীরে দেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার বাড়ল। এর মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই। ইংরেজ এল, তাই আমরা ইংরেজি বলতে কইতে পড়তে শিখলাম। কিন্তু যদি বলি, ইংরেজ এল তাই বাংলাটাও আমরা একটু ভালো করে লিখতে পড়তে শিখলাম, তাহলে অনেকেই চমকে উঠবেন, কেউ কেউ হয়ত চটেও যাবেন। কিন্তু কথাটা একেবারে আজগুবি বলে উড়িয়ে দেবার নয়। এর মধ্যে বেশ খানিকটা সত্য আছে। ইংরেজ অল্পদিনেই বুঝতে পেরেছে যে বাণিজ্য এবং রাজকার্য—দু’কাজেই দেশীয় ভাষাটা শিখে নেওয়া একান্ত আবশ্যক, তাতে কাজের যথেষ্ট সুবিধে হবে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছোকরা সাহেবরা সদ্য বিলেত থেকে এসে অথৈ জলে পড়ে। দেশের ভাষা জানে না বলে কাজ চালানো এদের পক্ষে কঠিন হয়ে ওঠে। কাজেই এদের বাংলা শেখাবার ব্যবস্থা অবিলম্বে করা প্রয়োজন। শুধু ভাষাটুকুই নয়, দেশের ইতিহাস সামাজিক রীতিনীতি প্রথা—লোকাচার দেশাচার সম্বন্ধে কিছু জ্ঞান না থাকলে শাসনকার্য চালানো সম্ভব নয়। ওদিকে বণিক এবং শাসক সম্প্রদায় ছাড়া আর এক দল ইংরেজ এ দেশে এসেছেন ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে। এঁরা খ্রিস্টান মিশনারি সম্প্রদায়, এসেছেন খ্রীষ্টের বাণী প্রচার করতে। এঁদের তাগিদটা আরোই জরুরি। তাঁরা কারো জন্য অপেক্ষা না করে দেশীয় পণ্ডিতদের সাহায্যে ইতিপূর্বেই বাংলা শেখার কাজে লেগে গিয়েছেন। তাঁরা জানতেন যে ধর্ম প্রচারের জন্য তাঁদের যেতে হবে গ্রামে গঞ্জে, সেকানে লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে হবে বাংলায়, ধর্ম প্রচার করতে হবে বাংলার মাধ্যমে। তখন এ দেশে ইংরেজি শিখেছে ক’জন লোক? খ্রিষ্টের বাণী প্রচার করতে হল বাইবল্ অনুবাদ করতে হবে বাংলা ভাষায়।

মিশনারি সাহেবরা আস্তানা করেছেন অদূরে শ্রীরামপুর শহরে। অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা উইলিয়াম কেরি। খ্রিষ্টের বাণী প্রচারে যতখানি তাঁর উৎসাহ, উদ্যম, বাংলা ভাষা শিক্ষায় এবং প্রচারে ততখানি। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃপক্ষ এবং স্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন একই সময়ে একই ব্যাপারে সমান তৎপর হয়ে উঠলেন। দু’পক্ষেরই সমান তাগিদ। কিন্তু একটা ভাষা শিখতে গেলে যে ভাষায় রচিত বইপত্রের সাহায্য চাই। বইপত্রের সন্ধান করতে গিয়ে এই প্রথম আবিষ্কার করা গেল যে বাংলাভাষায় রচিত কোনো গদ্যগ্রন্থ নেই? শুধু তাই নয়, বালা গদ্যের কোনো অস্তিত্বই নেই। ভাষা শিক্ষার পক্ষে গদ্য অত্যাবশ্যক। শিখতে হবে যে-ভাষায় লোকে কথা বলে, যে-ভাষায় কাব্যি করে সে-ভাষায় নয়।
প্রয়োজনের তাড়া বড় বিষম তাড়া। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর কালবিলম্ব না করে ইংরেজ কর্মচারীদের জন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। ১৮০০ সালে স্থাপিত হল ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ।

(ক্রমশ)