বাংলা গদ্যের ইতিবৃত্ত

ফাইল চিত্র

হীরেন্দ্রনাথ দত্ত

পূর্ব প্রকাশিতর পর

ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের সকলেরই অল্পবিস্তর পরিচয় আছে। সেখানেও এই একই কাহিনী। পদ্যে এবং গদ্যে কালের ব্যবধন আমাদের সাহিত্যে যতখানি, ইংরেজি সাহিত্যে ততখানি না হলেও মর্যাদার ব্যবধান ছিল যথেষ্ট। বাংলা গদ্যের আত্মপ্রকাশেই বিলম্ব হয়েছে, কিন্তু একবারও দেখা পাওয়া মাত্র তার যথোচিত সমাদরে আমরা কিছুমাত্র বিলম্ব করিনি। অনুমান একাদশ শতকে রচিত চর্যাপদকে যদি বাংলা কাব্যের সূচনা বলে স্বীকার করা হয় তাহলে আমাদের পদে এবং গদ্যে বয়সের ব্যবধান দাঁড়ায় প্রায় ৮০০ বছরের, কেননা বাংলা গদ্যের জন্ম উনিশ শতকের গোড়ায়। ইংরেজি সাহিত্যে গদ্যের আবির্ভাব চতুর্দশ শতকের শেষার্ধে। অন্যান্য সকল ভাষায় ন্যায় ইংরেজিতেও গোড়ার দিকে পদ্যেরই প্রাধান্য। গদ্য পরিমাণে যৎসামান্য, মর্যাদায় নগণ্য। পরবর্তী দুই শতাব্দীতেও অর্থাৎ পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতকের ইংরেজি গদ্যের শ্রীবৃদ্ধি তেমন কিছু হয়নি। ষোড়শ শতকে তো ইংলন্ডে কাব্যের আর নাট্যের মহোৎসব লেগে গিয়েছিল।


এলিজাবেথান যুগে সে কারণে ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। কিন্তু গদ্য যে সামান্যটুকু লেখা হয়েছিল, তা এমন গদগদ যে সেটা না গদ্য, না পদ্য। কবি নাট্যকাররা গদ্যকে অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। কৌতুকের বিষয় যে, এলিজাবেথীয় নাটকে রাজা রাজড়া পারিষদবর্গ অর্থাৎ অভিজাতরা কথা বলছেন পদ্যে, গদ্যের ব্যবহার নিম্ন শ্রেণীর পাত্র পাত্রীদের মুখে।পদ্য যে কুলীন আর গদ্য যে পতিত, এখানেই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। শেক্সপিয়ার-এর নাটকে এখানে ওখানে সামান্য ব্যতিক্রম থাকলেও, তিনিও মোটামুটি প্রচলিত প্রথাই মেনে চলেছেন। সে-যুগে ইংরেজি গদ্য রচনার ক্ষেত্রে একজন মাত্র লেখক একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন, তিনি ফ্রান্সিস বেকন। বেকন কবি নন, তিনি দার্শনিক। সে-যুগের ইংলন্ডে বেকন ছিলেন মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত।

গ্রিক ল্যাটিন ভাষায় অগাধ পাণ্ডিত্য কিন্তু ইংরেজি ভাষারপ্রতি বিষম অবজ্ঞা। তাঁর পান্ডিত্যপূর্ণ দার্শনিক গ্রন্থসমূহ সমস্তই ল্যাটিন ভাষায় রচিত। ইংরেজি ভাষাকে তিনি ঐ গুরুত্বপূর্ণ কাজের উপযোগী বলে মনেই করেননি। এক সময়ে এই মানুষটিই বোধকরি কোনো খেয়ালবশতঃ কিংবা নিতান্তই অবসর বিনোদনের উদ্দেশ্যে ইংরেজি ভাষায় কিছু সন্দর্ভ রচনা করেন। প্রত্যেকটি প্রবন্ধই সংক্ষিপ্ত, দুতিন পাতায় নিবন্ধ। Bacon’s Essays নামে ঐ ক্ষীণকায় প্রবন্ধ-পুস্তকটি ইংরেজি সাহিতেরে এক পরম সম্পদ। য়ে-কালের ইংরেজি গদ্যের গদগদ ভাষণ আজকের পাঠকের কাছে অপাঠ্য মনে হয় ঠিক সে-কালেই যে আবার এমন মেদলেশহীন সুসংহত সুগঠিত বাক্য রচনা সম্ভব হয়েছিল ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। প্রতিভাবানের পক্ষে কিছুই অসাধ্য নয়। ঐ ক্ষীণ-কলেবর প্রবন্ধ-পুস্তকটির দৌলতেই ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে বেকন অতি উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত।

(ক্রমশ)