• facebook
  • twitter
Tuesday, 24 December, 2024

বাংলা গদ্যের ইতিবৃত্ত

আগে যে অবসরের কথা বলেছি, সেই অবসর পেয়ে অবধি মানুষের মনে নানা শখের উদয় হয়েছে, নানা কথা নানা ভাব মনে এসে ভিড় করেছে, সেসব কথা প্রকাশের অভিলাষও হয়েছে।

ফাইল চিত্র

হীরেন্দ্রনাথ দত্ত

পূর্ব প্রকাশিতর পর

সংগীত সাহিত্য, চারুকলা কারুকলাসমস্তই মানুষের অবসর-জাত উদ্বৃত্তের প্রকাশ। উদ্বৃত্তের মধ্যেই কৃতিত্বের পরিচয়।
মানুষ তো সেই আদ্যিকাল থেকেই কথা বলে আসছে। কিন্তু কথা বলা এক, রসিয়ে কথা বলা আর। রসিয়ে কথা বলার নামই সাহিত্য। মানুষ যেদিন রসিয়ে কথা বলতে শিখল সেদিনই সাহিত্যের জন্ম হল। সহজে হয়নি। শত শত বছর ধরে ভাষা শুরু কাজের কথাই বলে এসেছে, রসের কথা বলেনি। যেদিন প্রথম কাজের কথা চেড়ে মনের খুশিতে অকেজো কথা বলার শখ হল সেদিনই ভাষার মুখে সত্যিকারের কথা ফুটল। বললে, এক যে ছিল রাজা—সবাই উৎকর্ণ হয়ে বলল, এ্যাঁ, তারপর? শুরু হল গল্প— খোশগল্প—কখনো আজগুবি, কখনো ঘরোয়া সুখ দুঃখের কথা। এই নিয়েই সাহিত্যের সংসার। শুধু গল্প কাহিনী নয়, রসিয়ে বলতে পারলে সকল কথাই শ্রুতিমধুর হয়।

আগে যে অবসরের কথা বলেছি, সেই অবসর পেয়ে অবধি মানুষের মনে নানা শখের উদয় হয়েছে, নানা কথা নানা ভাব মনে এসে ভিড় করেছে, সেসব কথা প্রকাশের অভিলাষও হয়েছে। কিন্তু মুশকিল বাঁধল ভাষা নিয়ে। তাদের মনে হল, নিত্যদিনের কাজে কর্মে হাঁকডাক চেঁচামেচি করে যে-ভাষায় তারা কথা বলে সেটা এ কাজের ঠিক উপযোগী নয়। এর চেহারাটা ঘাড়ে গর্দানে, জবরজঙ, ভঙ্গিটা পালোয়ানী, গলার স্বরটিও বড় মোলায়েম নয়। এর মুখে কি রসের কথা মানায়? রসের কথা চলে হাল্কা চালে; কিন্তু সেদিনের চলতি ভাষাটা—যাকে এখনআামরা বলি গদ্য—সেটা তখন ছিল ওজনে বিষম ভারি, তার চলন বলন আড়ষ্ট, তাকে হেলানো দোলানোকষ্ট। রসের কথা সে বলবে কী করে?

এক সময়ে মানুষ আবিষ্কার করেছিল যে একটা খুব ভারি জিনিস যাকে বয়ে নিতে পাঁচজন লোক লেগে যায় তার গয়ে যদি দুটো চাকা লাগিয়ে নেয় তাহলে একজন লোকই সেটাকে অতি সহজে ঠেলে নিয়ে যেতে পারে। ভাষার বেলায়ও তাই হয়েছে। আগেই বলেছি, একদিন কোনো রসিক ব্যক্তির মনে হঠাৎ খেয়াল হল, মুখের কথার ছাঁদ পাল্টিয়ে ছন্দের দোলা লাগিয়ে কথাগুলোকে একটু যদি নাচিয়ে দেওয়া যায় তাহলে বোধকরি মানুষের মনকেও মাতিয়ে দেওয়া যাবে। পরখ করে দেখলে কথাটা ঠিক—ছন্দোবদ্ধ পদ নিজের কানেই সুধা বর্ষণ করল, যে শুনল তার কানেও। ঐ ছন্দটাই চাকার কাজ করেছে। গদাইলস্করী গদ্য চলে গড়িয়ে গড়িয়ে। এখন ছন্দের চাকাটি পেয়ে সেই ভাষাই চলতেলাগল দিব্যি গড় গড় করে।

ছন্দোবদ্ধ পদ-রচনা দিয়েই সাহিত্যের পদযাত্রা শুরু। সকল দেশের সকল সাহিত্যেই এক রীতি। গদ্যকে সাহিত্য রচনার যোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়নি। নিত্যদিনের আটপৌরে ভাষায় কাব্যসাহিত্যের মতো শৌখিন জিনিসের সৃষ্টি কখনই সম্ভব নয়, এরূপ একটা ধারণা সেকালের লেখকদের মনে বদ্ধমূল ছিল। সেজন্য গদ্য বহুকাল থেকে গেল সাহিত্যসমাজে অস্পৃশ্য। কেউ তার দিকে ফিরেও তাকায়নি। ওকে দিয়ে মুটে-মজুরের মতো ভারি রকমের মোটা রকমের কাজ করিয়েছে, ফাইফরমাস খাটিয়েছে। কোনো শখের কাজে, চিকন কাজে তাকে ডাকা হয় নি. রসের কথা নিয়েই কাব্যসাহিত্যের কারবার। কিন্তু রসের কথা যে গদ্যেও বলা যায় সে-কথাটি আবিষ্কার করতে লেগে গিয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। ফলে বহুকাল কেটেছে অনাদরে অবহেলায়। সাহিত্যের সম্ভ্রান্ত আসরে প্রবেশের অধিকার পায়নি।

(ক্রমশ)