• facebook
  • twitter
Thursday, 30 January, 2025

বাংলা গদ্যের ইতিবৃত্ত

পন্ডিত ব্যক্তিরা বঙ্কিমের ভাষাকে গুরুচন্ডালী দোষদুষ্ট বলে গাল দিয়েছেন

ফাইল চিত্র

হীরেন্দ্রনাথ দত্ত

পূর্ব প্রকাশিতর পর

রবীন্দ্রযুগের সব চাতে জনপ্রিয় লেখক শরৎ চট্টোপাধ্যায়। শরৎচন্দ্র তাঁর গল্প উপন্যাসের মাধ্যমে বাঙালি চিত্তকে যেভাবে স্পর্শ করেছিলেন, তাঁর পূর্বে বা পরে অপর কোন লেখকের পক্ষেই তা সম্ভব হয়নি। প্রথম উপন্যাস রচয়িতা হিসাবে বঙ্কিমচন্দ্র নিঃসন্দেহে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিলেন; কিন্তু জনপ্রিয়তায় শরৎচন্দ্র বঙ্কিমকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন, কেন না ততদিনে শিক্ষা বিস্তারের ফলে পাঠকসমাজেরও কিছু বিস্তার ঘটেছল। মস্ত বড় কৃতিত্বের কথা বলতে হবে যে রবীন্দ্র-প্রতিভার অত্যুজ্জ্বল দীপ্তিও শরৎচন্দ্রের দিব্য বিভাগে ম্লান করতে পারেনি। সে দিনের পাঠক সমাজে কবি হিসাবে রবীন্দ্রনাথ যে উচ্চাসন লাভ করেছিলেন, কথাসাহিত্যিক হিসাবে শরৎচন্দ্রকেও অনুরূপ উচ্চাসনে বসানো হয়েছিল। নিজ নিজ ক্ষেত্রে দুজনেই অতুলনীয় আখ্যা লাভ করেছিলেন।

এ মুহূর্তে আমরা বাংলা গদ্যের আলোচনায় প্রবৃত্ত। কাজেই উপন্যাসের গুণাগুণ বিবেচনা ছেড়ে বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশে শরৎচন্দ্রের অবদান সম্পর্কে আলোচনাই এখানে যথোচিত হবে বলে মনে করি। বলতে বাধা নেই যে বাংলা গদ্যের নির্মাতা হিসাবে যে সব ভাষা-শিল্পী চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন শরৎচন্দ্র তাঁদের অন্যতম। আমরা আগেই দেখেছি, বাংলা গদ্যকে সাহিত্যের রূপ দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র যখন উপন্যাস রচনায় হাত দিলেন তখন বুঝতে বিলম্ব হয়নি যে বিদ্যাসাগরী বাংলাটা সংস্কৃত শব্দে ভারাক্রান্ত বলে ওজনে একটু ভারী। এ ভাষা বড় মন্থর-গতি। মন্থরাকে একটু মুখরা এবং চটুলা করে দিতে হবে নইলে ওর মুখে রসের কথা ঠিক ফুটবে না।

সেজন্য সংস্কৃত শব্দ ছেড়ে বঙ্কিম অনেক সময় প্রাকৃত শব্দ ব্যবহার করেছেন। সে দিনের পন্ডিত ব্যক্তিরা বঙ্কিমের ভাষাকে গুরুচন্ডালী দোষদুষ্ট বলে গাল দিয়েছেন। তাহলেও স্বীকার করতে হবে যে ভাষার গতিকে তিনি অনেকখানি স্বচ্ছন্দ করে এনেছিলেন। বঙ্কিমের ভাষাস্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যুক্ত করেছিলেন লালিত্য। রবীন্দ্রনাথের গদ্যে কাব্যিয়ানা নেই কিন্তু বোধ করি কবি মনের সৃষ্টি বলেই সে ভাষা অতি মাত্রায় মার্জিত এবং মসৃণ, সর্বদাই সজ্জিত শোভন তার মূর্তি। শরৎচন্দ্র রবীন্দ্রগদ্যের অনুগামী কিন্তু সাজসজ্জার প্রতি খুব একটা আগ্রহ দেখাননি। শরৎবাবু যেমন বাঙালি গরের গরোয়া গল্প লিখেছেন, তাঁর ভাষাও তেমনি ঘরোয়া। ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘রামের সুমতি’, ‘মেজদিদি’ প্রভৃতি গল্পে সে ভাষা চমৎকার মানিয়ে গিয়েছে। অলংকারবিহীন ঝরঝরে ভাষা অবাধ স্রোতে তর তর গতিতে বয়ে চলেছে। এই সহজ সরল স্বচ্ছ স্বচ্ছন্দ গদ্য একান্তভাবেই শরৎচন্দ্রের সৃষ্টি।

রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্র দু’জনে একই সময়ে গল্প উপন্যাস রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষাটা ঠিক অনুকরণসাধ্য ছিল না; বিশেষ করে শেষ দিকের গল্প উপন্যাস রবীন্দ্রনাথের ঠাট ঠমকটা এতই চমকপ্রদ হয়ে উঠেছিল যে অপরের পক্ষে তা আয়ত্ত করা বলতে গেলে সাধ্যাতীত ছিল। নব্য লেখকেরা সে পথে যেতে সাহস করেননি; বুদ্ধির কাজ করেছেন।

(ক্রমশ)