পূর্ব প্রকাশিতর পর
কিন্তু খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকের প্রারম্ভ হইতে, পশ্চিম হইতে আগত বিদেশী তুর্কী মুসলমান বিজেতাদের দ্বারা পশ্চিম বঙ্গ বিজয়ের পরে, ও ক্রমে মুসলমান শক্তি কর্তৃক পূর্ব বঙ্গ বিজয় ঘটিয়া গেলে, সারা দেশের জন্য একটি নাম মুসলমান শাসকগণ কর্তৃক গৃহীত হয়, —‘বঙ্গাল’ শব্দের আধারে। ‘বঙ্গালহ্’—এই ‘বিস্তৃত’ রূপ, মিলিতভাবে গৌড়-বঙ্গ উভয় অঞ্চলের জন্য গৃহীত হইয়া যায়; এবং ‘বঙ্গালহ্’ (উচ্চারণে ‘বঙ্গালা’) শব্দের উত্তর বিশেষণার্থে ‘ঈ’ প্রত্যয় যোগ করিয়া ‘বঙ্গালী’—সারা বাঙ্গালার অধিবাসী। কিন্তু কেবল পূর্ব বঙ্গের অধিবাসী অর্থে ‘বঙ্গাল’ শব্দ প্রচলিত থাকে—আধুনিক কালে বাঙ্গালীর মুখে ইহার উচ্চারণ দাঁড়াইয়াছে বাঙ্গাল (পূর্ব-বঙ্গে), ও ‘বাঙাল’ (পশ্চিম বঙ্গে)। বাঙ্গালীর মুখে আর কয়েকটি সংক্ষিপ্ততর রূপ শোনা যায় ‘বাঙ্গালা’ হইতে ‘বাঙ্গ্লা’, ‘বাঙ্লা’ (‘বাংলা’)— প্রথম অক্ষরের উপরে প্রবল বলাঘাতের ফলে, দ্বিতীয় অক্ষরের ‘আ’ স্বরধ্বনির লোপ ঘটে। এই ‘বাঙ্গ্লা’ শব্দকেই আবার হিন্দীতে লেখা হয় ‘বংলা’, বঁগলা, বঙ্গ্লা’ রূপে। ফরাসীর ‘বঙ্গালহ্’ হইতে খ্রীষ্টীয় ১৫০০-র পর হইতে নানা ইউরোপীয় ভাষায় Bengala, Bengalla, Bengall, Bengal প্রভৃতি, এবং দেশের লোক জানাইতে Bengalese, Bengalee, Bengali প্রভৃতি রূপ প্রযুক্ত হইতে থাকে।
রবীন্দ্রনাথ কবি; কিন্তু কাব্য রচনায় গদ্য রচনায়— উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর সমান কৃতিত্ব। পরিমাণের দিক থেকে গল্প উপন্যাস নাটক প্রবন্ধ এবং চিঠিপত্র সমেত তাঁর সমগ্র গদ্য রচনা, কাব্য রচনার তুলনায় বোধ করি চতুর্গুণ হবে। কোনো দেশের কোনো কবি এমন বিপুল পরিমাণে গদ্য রচনা করেননি. বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় যে কবির রচিত গদ্য হলেও সে গদ্যে বিন্দুমাত্র কাব্যিয়ানা নেই। গদ্য পদ্যের স্বভাবধর্ম সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ আতিমাত্রায় সজাগ ছিলেন। তাঁর গদ্য কখনো ভাবাবেগে বেসামাল নয়। অতুল গুপ্ত মশায় এ কথাটি বড় সুন্দর করে বলেছিলেন। ‘রবীন্দ্রনাথের গদ্য মহা কবির গদ্য, কিন্তু ভুলেও পদ্য-গন্ধী নয়।’
তবে কবি মানুষ বলেই প্রতিটি বাক্যের শ্রীছাঁদ সম্পর্কে তিনি অতিশয় সচেতন ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে সাহিত্য শিল্পী মাত্রই এ বিষয়ে বিশেষভাবে সজ্ঞান। ‘বর্ণ-পরিচয়’-এ বিদ্যাসাগরের বাক্যগঠন প্রণালী লক্ষ্য করলে তাতেও এ জিনিসটি নজরে পড়বে। বঙ্কিমচন্দ্রের গদ্যেও তা সুস্পষ্ট। ‘সূর্যমুখীর পিত্রালয় কোন্নগর’— এ-বাক্যের rhythm বা ছন্দ লক্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথের গল্পে (স্ত্রীর পত্র)— ‘আামি এসেছি তীর্থ করতে শ্রীক্ষেত্রে’—এটিও একটি ছন্দোবদ্ধ বাক্য। ‘গদ্য ছন্দ’ কথাটি আজগুবি নয়; গদ্যকেও শ্রীছাঁদ রক্ষা করে চলতে হয়। ইংরেজ লেখক বলেছেন— Prose, too, his its cadences—খুব খাঁটি কথা. এই যে শ্রীছাঁদের কথা বলছি তাতে বাক্যের কাব্যগুণ বাড়ে না, প্রসাদগুণ বাড়ে। গদ্য গদ্যই থাকে, কাব্যের মুখোশ পরে না। রবীন্দ্রনাথের গদ্য মার্জিত-রুচি, সংযত-বাক্, উজ্জ্বল তার মুখশ্রী। এতখানি ঔজ্জ্বল্য বাংলা গদ্যে ইতিপূর্বে দেখা যায়নি।
আপন প্রয়োজনের তাগিদেই ভাষার শক্তি বৃদ্ধির কথা রবীন্দ্রনাথকে সারাক্ষণ ভাবতে হয়েছে। এত বিভিন্ন এবং এত বিচিত্র বিষয়ে তাঁকে লিখতে হয়েছে যে বিষয়ভেদে ভাষার পার্থক্য এবং শব্দের ধ্বনিগত তাৎপর্য সম্পর্কে তাঁকে সর্বক্ষণ সজাগ থাকতে হয়েছে। মানবিক প্রেম এবং ভগবৎ প্রেম, পার্থিব সম্পদ এবং অপার্থিব সম্পদ, আর্থিক লাভক্ষতি এবং পারমার্থিক লাভালাভ, ইন্দ্রিয়াসক্তি এবং অতীন্দ্রিয় অনুভূতি—প্রত্যেকটি ভিন্ন বস্তু, ভিন্ন ভাব।
(ক্রমশ)