হীরেন্দ্রনাথ দত্ত
পূর্ব প্রকাশিতর পর
দেশে ইংরেজি শিক্ষার পত্তন হল হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় (১৮১৭)। হিন্দু কলেজ ছিল বিলিতিয়ানার পীঠস্থান। ছাত্ররা অশনে বসনে ভাষণে বিলিতি ভাবাপন্ন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে মাইকেল মধুসূদন, রাজনারায়ণ বসু, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, মায় টেকচাঁদ সকলেই হিন্দু কলেজের ছাত্র। পরে বিলিতি ইস্কুলের ইংরেজি-নবিশ ঐ সব ছাত্ররাই মাতৃভাষা চর্চায় অগ্রগণ্য ভূমিকা গ্রহণ করলেন। মনে হয় একটি মহৎ সাহিত্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়ার ফলে তাঁরা মাতৃভাষার দৈন্য সম্বন্ধে অধিকতর সজ্ঞান সচেতন হয়েছিলেন। এছাড়াও আরেকটি কাজও তাঁরা করেছেন; বাংলা গদ্যকে তাঁরা সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের প্রভাব থেকে অনেকখানি মুক্ত করেছিলেন। বিদ্বান পণ্ডিতদের কৃপায় ভাষার সবলতা যতখানি বেড়েছে, সাবলীলতা ততখানি নয়। ভূদেব সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত বংশের ছেলে, নিজেও সংস্কৃতজ্ঞ। কিন্তু তাঁর ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’ ‘সামাজিক প্রবন্ধ’ প্রভৃতি গ্রন্থ যে ভাষায় লেখা তাকে কোনমতেই পণ্ডিতি ভাষা বলা চলে না। ইংরেজি শিক্ষার গুণেই তা সম্ভব হয়েছিল। মাইকেল এবং ভূদেবের সহপাঠী রাজনারায়ণ বসু সে যুগের অপর এক প্রতিভাবান লেখক। তাঁর রচিত ‘সেকাল আর একাল’ (১৮৭৪)—শতাধিক বর্ষ পূর্বে রচিত হলেও আজকের পাঠকের কাছেও সুখপাঠ্য বিবেচিত হবে। তাঁর ভাষ্য শুধু সহজ স্বচ্ছন্দ নয়, সাহিত্যেরক প্রসাদগুণে প্রসন্ন।
(তিন)
বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য— দু’ই এখন একটা নতুন পরিণতির পথে অগ্রসর হল। ভাষার সবলতা, সাবলীলতা দু’ই বেড়েছে; কিন্তু একটি গুণের অভাব তখনো থেকে গিয়েছে। সে গুণটি হল ভাষার লালিত্য। এটি যতক্ষণ না আসবে ততক্ষণ মন কাড়বার অর্থাৎ মন মজাবার ক্ষমতা আাসে না। মনে হয় প্রথম যুগের লেখকদের বেশির ভাগেরই ধারণা ছিল, গদ্য প্রধানত বিদ্যার বাহন, বিদ্যা দানই তার প্রধান কাজ। সেজন্যে সে গম্ভীর মুখে গভীর কথা বলতে শিখেছে, কিন্তু মন খুলে মনের কথা বলতে শেখে নি। জ্ঞানের কথার চাইতেও বড় জিনিস মনের কথা। সাহিত্যের আবেদন নিবেদন মানুষের মনের কাছে। ভাষা যেদিন ঐ মনের কথা বলতে শিখবে সেদিন সাহিত্যের জন্ম হবে। মনে রাখতে হবে যে সাহিত্যকে শিক্ষকের ভূমিকায় ঠিক মানায় না। সাহিত্যের ভূমিকা হবে রসিকের ভূমিকা, শিল্পীর ভূমিকা। আনন্দ দানই তার প্রধান কাজ। শুধু বিদ্যাচর্চার দ্বারা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি হয় না, সিদ্ধিলাভও হয় না। যতক্ষণ না তাকে সৃজনশীল কাজে লাগানো যাচ্ছে ততক্ষণ তার জড়তা কাটে না, আড়ষ্টতা ঘোচে না। এ যাবৎ অনেক মননশীল লেখকের সঙ্গে আাদের সাক্ষাৎ হয়েছে কিন্তু তেমন কোন সৃজনশীল প্রতিভার আবির্ভাব তখনো ঘটেনি।
ভাষাকে সাহিত্যের দীক্ষা গ্রহণ করতে হয়। বাংলা ভাষা সে দীক্ষা গ্রহণ করেছে বঙ্কিমের হাত থেকে। প্রতিভার স্পর্শ সোনার কাঠির স্পর্শের ন্যায়। বঙ্কিম প্রতিভার স্পর্শে বাংলা গদ্যভাষা শুধু যে জেগে উঠল এমন নয়, দিব্য দৃষ্টি লাভ করল। দৃষ্টি দিকে দিকে প্রসারিত হল। আধুনিক জগৎ, আধুনিক জীবনের সঙ্গে পরিচয় ইতিপূর্বেই ঘটেছে পূর্বে উল্লেখিত মনস্বীবৃন্দের দৌত্যে; সে পরিচয় ঘনিষ্ঠতর হল বঙ্কিমের দৌলতে। ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’-এর বার্তা বঙ্কিমই পৌঁছিয়ে দিলেন বাঙালির ঘরে ঘরে।
বঙ্কিমের প্রথম উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনীর প্রকাশ ১৮৬৫ সালে। ভাবলে বিস্ময়ের সীমা থাকে না যে, যে ভাষায় প্রথম গদ্য গ্রন্থের প্রকাশ ১৮০১ সালে সে ভাষায় মাত্র চৌষট্টি বছরের ব্যবধানে উপন্যাস রচনা সম্ভব হল। ইংরেজি ভাষায় গদ্যের জন্ম চতুর্দশ শতকের শেষার্ধে কিন্তু উপনাসের জন্ম হয়েছে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে (১৭৪০) অর্থাৎ আমাদের যেখানে লেগেছে চৌষট্টি বছর ইংরেজি সাহিত্যের সেখানে পৌঁছোতে লেগেছে সাড়ে তিন শ’ বছর।
(ক্রমশ)