বাংলা গদ্যের ইতিবৃত্ত

হীরেন্দ্রনাথ দত্ত

পূর্ব প্রকাশিতর পর

প্রয়োজন ব্যতিরেকে মন যখন অকারণে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কথা বলবে এবং ভাষায় তা প্রকাশ করবে তখনই সাহিত্যের জন্ম হবে। ‘বর্ণপরিচয়’ থেকে শুরুকরে ‘বোধোদয়’, ‘কথামালা’, ‘আখ্যানমঞ্জরী’ প্রভৃতি পুস্তক প্রধানত বালক-বালিকাদের জন্য কিছু পাঠোপযোগী সামগ্রীর সংকলন। বঙ্কিমচন্দ্র এক সময়ে একটু অবজ্ঞার সুরে বলেছিলেন—ছেলেমেয়েদের উপযোগী কিছু পাঠ্যকেতাব ছাড়া বিদ্যাসাগর আর কি লিখেছেন? সংস্কৃত শব্দের আধিক্যবশত বিদ্যাসাগরের ভাষাও বঙ্কিমের ঠিক পছন্দসই ছিল না।

একথা ঠিক যে বালক বালিকাদের জন্য পুস্তক রচনা করেছেন প্রচুর কিন্তু ভুললে চলবে না যে ভাষার পথ নির্মাণে অগ্রসর হতে হতেই সাহিত্যের পথ উন্মুক্ত হয়েছে। বিদ্যাসাগর যখন তাঁর ‘শকুন্তলা’ এবং ‘সীতার বনবাস’ রচনা করেছেন সেই তখনই বাংলা গদ্যে প্রথম সাহিত্যের স্বাদ গন্ধ পায়ো গেল। ‘সীতার বনবাস’ থেকেএকটু অংশ উদ্ধৃত করছি— ‘‘এই সেই জনস্থানমধ্যবর্ত্তী প্রস্রবণ গিরি। এই গিরির শিখরদেশ আকাশপথে সতত সঞ্চরমাণ জলধরমন্ডলীর যোগে নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কৃত; অধিত্যকা প্রদেশ ঘন সন্নিবিষ্ট বিবিধ বনপাদপসমূহে আচ্ছন্ন থাকাতে সতত স্নিগ্ধ, শীতল ও রমণীয়; পাদদেশে প্রসন্নলিলা গোদাবরী তরঙ্গবিস্তার করিয়া প্রবল বেগে গমন করিতেছে।’’

সংস্কৃত-জাত আভিধানিক শব্দের বাহুল্য সত্ত্বেও এ ভাষারসাহিত্য-সুলভ লালিত্য কেউ অস্বীকার করবে না। বঙ্কিমচন্দ্র পূর্বে যাই বলে থাকুন, পরে তাঁর মত পরিবর্তন করেছিলেন। বলেছেন, ‘‘বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষা অতি সুমধুর ও মনোহর। তাঁহার পূর্বে কেহই এরূপ সুমধুর বাঙ্গালা গদ্য লিখিতে পারে নাই, এবং তাঁহার পরেও কেহ পারে নাই।’’ সব চাইতে বড় স্তুতিবাক্য উচ্চারিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের মুখে। বলেছেন, বানীর দেউলে প্রবেশ দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। সেই দ্বার পথেই সকল সাহিত্যসেবী প্রবেশ করেছেন বঙ্গবানীর প্রাঙ্গণে। আরো বলেছেন— ‘‘বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী। … তিনিই সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যে কলনৈপুণ্যের অবতারণা করেন।’’

বিদ্যাসাগরের সমকালীনদের মধ্যে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ পরিমাণে বেশি না লিখলেও গুণপনায় বাংলা গদ্যের সৌষ্ঠব বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছেন। লিখেছেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। মনটি ছিল অনুভূতি প্রবণ; সেই মন নিয়ে যখন যেমন ভেবেছেন সে ভাবে লিখেছেন. তাঁর আাত্মজীবনী থেকে কয়েক পংক্তি উদ্ধার করলে লেখার ধাঁচটা ঠিক বোঝা যাবে—

‘‘বহু পূর্বে প্রথম বয়সে আমি যে অনন্ত আকাশ হইতে অনন্তের পরিচয় পাইয়াছিলুম, একদিন ভাবিতে ভাবিতে তাহা হঠাৎ আমার মনে পড়িয়া গেল। আবার আমি একাগ্র মনে অগণ্য গ্রহ নক্ষত্র খচিত এই অনন্ত আকাশের উপরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলাম, এবং অনন্তদেবকে দেখিলাম. বুঝিলাম যে অনন্ত দেবেরই এই মহিমা; তিনি অনন্ত জ্ঞান স্বরূপ। যাঁহা হইতে আমরা পরিমিত জ্ঞান ও তাহার আধার এই অবয়ব পাইয়াছি, তাঁহার কোন অবয়ব নাই; তিনি শরীর ও ইন্দ্রিয়-রহিত। তিনি হাত দিয়া এই বিশ্ব গড়ান নাই; কেবল আপনার ইচ্ছা দ্বারাএই জগৎ রচনা করিয়াছেন।’’

মহর্ষি প্রতিষ্ঠিত ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র সম্পাদনা কার্যে যুক্ত ছিলেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর এবং যে যুগের অপর এক খ্যাতনামা লেখক অক্ষয়কুমার দত্ত। কাজেই অনুমান করা কিছুই কঠিন নয় যে বাংলা গদ্যের বিকাশে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার একটি বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল। পশ্চিম দেশ থেকে বিজ্ঞানের বার্তা সবে এদেশে এসে পৌঁচেছে। অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন বিজ্ঞান বিষয়ে কৌতূহলী, বিজ্ঞানের আলোচনায় আগ্রহী। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা কালে তিনি প্রতি সংখ্যায় একটি করে বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ লিখতেন। সে সব প্রবন্ধ পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। তিনিই এ দেশে বিজ্ঞানের প্রথম লেখক শিক্ষক এবং প্রচারক। সে যুগের অপর এক মনস্বী ব্যক্তি রাজেন্দ্রলাল মিত্র।
(ক্রমশ)