বাংলা গদ্যের ইতিবৃত্ত

ফাইল চিত্র

হীরেন্দ্রনাথ দত্ত

পূর্ব প্রকাশিতর পর

তাঁর ‘বিবিধার্থ সঙগ্রহ’ নামক পত্রিকায় ইতিহাস এবং পুরাতত্ত্ব বিষয়ে রাজেন্দ্রলালের বহু পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা প্রকাশিত হয়েছিল। বিজ্ঞান চিন্তা এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবর্তনার দ্বারা এই দুই মনস্বী বাংলা গদ্যের বিকাশে যথেষ্ট অবদান জুগিয়েছেন।


বাঙালির চিন্তাকে এক নতুন খাতে প্রবাহিত করেছিলেন বলে রবীন্দ্রনাথ অক্ষয়কুমার এবং রাজেন্দ্রলালের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন. বলেছেন, ‘‘আামাদের বাল্যকালে আমরা একটি নতুন যুগের অবতারণা দেখেছি. প্রাচীন পান্ডিত্যের সঙ্গে য়ুরোপী বিচার পদ্ধতির সম্মিলনে এই যুগের আবির্ভাব। অক্ষয়কুমার দত্তের মধ্যে তার প্রথম সূত্রপাত দেখা গিয়েছিল। তারপর তার পরিণতি দেখেছি রাজেন্দ্রলাল মিত্রে। সেদিন এশিয়াটিক সোসাইটির প্রযত্নে প্রাচীনকাল থেকে আহরিত সাহিত্য এবং পুরাতত্ত্বের অনেক উপকরণ জমে উঠল। সেই সব অসংশ্লিষ্ট উপাদানের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সত্যকে উদ্ধারকরবার কাজে তিনি অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। … আধুনিক কালের বিদ্যাধারার জন্যে বাংলা ভাষার মধ্যে খাত খনন করার কাজে তিনি প্রধান অগ্রণী ছিলেন। তাঁর দ্বারা প্রকাশিত‘‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ তার প্রমাণ।’’

এ যাবৎ বাংলা গদ চলছিল বিদ্যাসাগর প্রদর্শিত পথে সতর্ক সংযত পদক্ষেপে। অকস্মাৎ এক বিরাট চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলেন প্যারিচাঁদ মিত্র (টেকচাঁদ ঠাকুর)। বিদ্যাসাগর প্রবর্তিত সংস্কৃত-ঘেঁষা বাংলা ভাষা ঠিক তাঁর মনঃপুত হয়নি। তাঁর আপত্তির কারণ, সে ভাষা অল্প-শিক্ষিতের পক্ষে বেঝা কঠিন। তাঁর মতে, লোকে য়ে ভাষায় কথা বলে, লিখন পঠনের ভাষাকে যতটা সম্ভব তার কাছাকাছি নিয়ে আসা বাঞ্ছনীয়। যৎকিঞ্চিৎ লেখাপড়া জানে এমন স্ত্রী-পুরুষের জনে পাঠোপযোগী বইপত্র আমাদের ভাষায় নেই বললেই চলে। প্যারীচাঁদ মিত্র এ-অভাবটি দূর করবার জন্যে বিশেষ সচেষ্ট ছিলেন। স্বল্প শিক্ষিতা মহিলাদের জন্যে একখানা পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন। তাতে নানা খবরবার্তা ছাপা হত, নানা বিষয়ের আলোচনা থাকত কিন্তু সমস্তই অতি সহজ সরল ভাষায়। প্যারীচাঁদ মিত্র উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন; নানা বিষয়ে নানা গ্রন্থ রচনা করেছেন। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে তাঁর খ্যাতি প্রধানত ’আলালের ঘরের দুলার্ল নামক গ্রন্থের লেখক হিসাবে সংক্ষেপে বলতে গেলে ’আলালি’ ভাষার স্রষ্টা রূপে। আমরা আজ যাকে কথ্য বা চলিত ভাষা বলি, আলালি ভাষা ঠিক তা নয়। টেকচাঁদ সাধু ভাষার কাঠামোটি রক্ষা করে সাধারণের ব্যবহৃত বহু অন্ত্যজ শব্দের আমদানি করে সাধু ভাষার গুমোর অনেকখানি ভেঙে দিয়েছেন। তাতে ভাষাটা অপেক্ষাকৃত সহজবোধ্য এবং একটু বেশি জীবন্তও হয়েছে। সামান একটু নমুনা দেখা যাক্— ‘‘বাবুরাম বাবু ইতস্ততঃ বেড়াইয়া চাকরকে বলছেন—ওরে হরে! শীঘ্র বালি যাইতে হইবে, দুই চার পয়সায় একখানা চলতি পানসি ভাড়া কর তো। বড় মানুষের খানসামারা মধ্যে ২ বেআদব হয়, হরি বলিল, মোশায়ের যেমন কাণ্ড! ভাত খেতে বস্তেছিনু— ডাকাডাকিতে ভাত ফেলে রেখে এস্তেচি। … চলতি পানসি চার পয়সায় ভাড়া করা

আমার কর্ম্ম নয়— কি কি থুতকড়ি দিয়ে ছাতু গোলা?’’
শেষ বাক্যটিতে চলতি ইডিয়মের ব্যবহার লক্ষণীয়।

সে যুগের অপর এক প্রতিভাবান ব্যক্তি কালীপ্রসন্ন সিংহ। অতি অল্প দিনের জীবনে অনেক কাজ করে গিয়েছেন। বিদ্যাচর্চা তাঁর এক বিরাট কীর্তি। লোকে বলে তাঁর অর্থানুকূল্যে সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতবর্গই কর্মটি সমাধা করেছিলেন। তাহলেও তাঁর কৃতিত্বের খুব একটা লাঘব হয় না। নিজে সাহিত্যিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন।

(ক্রমশ)