বাংলা গদ্যের ইতিবৃত্ত

ফাইল ছবি

হীরেন্দ্রনাথ দত্ত

পূর্ব প্রকাশিতর পর

গোড়ার দিকে সকল জিনিসেই একটু জড়তা থাকে; আস্তে আস্তে জট ছাড়িয়ে তাকে সহজ করে নিতে হয়। ক্রমবিকাশের জন্যে যে গুণটি সর্বাপেক্ষা বেশি প্রয়োজন, সেটি হল সাবলীলতা। ভাষার পক্ষেও অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সঞ্চালনের অনায়াস ক্ষমতা অর্থাৎ বাক্যের বিভিন্ন অংশগুলির সহজ এবং স্বচ্ছন্দ বিন্যাসের কৌশল আয়ত্ত করা একান্ত আবশ্যক। ঐ সুবিন্যস্ত বাক্য রচনার কৌশলটি বিদ্যাসাগরই আমাদের শিখিয়েছেন। রামমোহন যে ভাষাকে সচকিত করে দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর তাকে অধিকতর সপ্রতিভ করে তুলেছেন।


‘‘বিদ্যাসাগরী বাংলা’ বলে একটা বিদ্রূপাত্মক কথা শিক্ষিত মহলে এক সময়ে প্রচলিত ছিল, এখনও মাঝে মাঝে শোনা যায়। ভাষার উৎপত্তি এবং ক্রম পরিণতি সম্বন্ধে অজ্ঞতাবশতই আমরা এরূপ ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হই। অত্যন্ত সাধারণ মোটা রকমের কাজে ব্যবহৃত অর্থাৎ গুরুতর কাজে অনভ্যস্ত ভাষাকে সুবিন্যস্ত সুরুচিসম্পন্ন ভাব-প্রকাশের উপযোগী করে দেওয়া কিংবা সাধারণের অপরিচিত আভিধানিক শব্দের গুমর ভাঙিয়ে তাকে ঘরোয়া ব্যবহারে লাগানো যে কী কঠিন কাজ, আমাদের পক্ষে তা বোঝা সহজ নয়। বিদ্যাসাগর সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত; তাঁর রচনায় সংস্কৃত শব্দের প্রাচুর্য থাকা কিছুই বিচিত্র নয়। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এ বিষয়ে তাঁর কোন গোঁড়ামি ছিল না; বরং শব্দ প্রয়োগে আশ্চর্য সংগতিবোধ প্রকাশ পেয়েছে। একটি দৃষ্টান্ত দিলেই কথাটা স্পষ্ট হবে। ‘কথামালার’ গল্পে বলছেন— ‘‘এক দুঃখী নদীর তীরে গাছ কাটিতেছিল। হঠাৎ কুঠারখানি তাহার হাত হইতে ফস্কিয়া নদীর জলে পড়িয়া গেল।’’ সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতের পক্ষে এরূপ প্রাকৃত শব্দের (ফস্কিয়া) ব্যবহার তখনকার দিনে খুব সহজ বা স্বাভাবিক ছিল না। বেশ বোঝা যায়, শিল্পীর ন্যায় খুঁতখুঁতে মন নিয়ে বিচার-বিবেচনা করে শব্দ প্রয়োগ করেছেন। বিদ্যাসাগরের বাংলা রচনা পাঠ করে সেকেলে সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত অবজ্ঞা ভরে বলেছিলেন—ছাই লিখেছে, সবই তো বোঝা যায়। আজ যাঁরা বিদ্যাসাগরের ভাষাকে পন্ডিতি ভাষা বলে জাতে ঠেলেছেন তাঁরাও ভাষার ক্রমবিকাশ সম্পর্কে একই ধরনের ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করছেন।

তবে একথা স্বীকার করতে হবে, বাংলা গদ্য এখনও শুধু প্রয়োজনটুকু মেটাতেই ব্যস্ত, কোন প্রকার শখ মেটাবার কথা এখনও ভাবছে না। সোজা কথায় বাংলা গদ্য এখনও ঠিক সাহিত্যেরস্তরে এসে পৌঁছয়নি।

(ক্রমশ)