• facebook
  • twitter
Saturday, 11 January, 2025

বাংলা গদ্যের ইতিবৃত্ত

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এ বিষয়ে তাঁর কোন গোঁড়ামি ছিল না; বরং শব্দ প্রয়োগে আশ্চর্য সংগতিবোধ প্রকাশ পেয়েছে। একটি দৃষ্টান্ত দিলেই কথাটা স্পষ্ট হবে।

ফাইল চিত্র

হীরেন্দ্রনাথ দত্ত

পূর্ব প্রকাশিতর পর

রামমোহন যে ভাষাকে সচকিত করে দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর তাকে অধিকতর সপ্রতিভ করে তুলেছেন।  ‘‘বিদ্যাসাগরী বাংলা’ বলে একটা বিদ্রূপাত্মক কথা শিক্ষিত মহলে এক সময়ে প্রচলিত ছিল, এখনও মাঝে মাঝে শোনা যায়। ভাষার উৎপত্তি এবং ক্রম পরিণতি সম্বন্ধে অজ্ঞতাবশতই আমরা এরূপ ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হই। অত্যন্ত সাধারণ মোটা রকমের কাজে ব্যবহৃত অর্থাৎ গুরুতর কাজে অনভ্যস্ত ভাষাকে সুবিন্যস্ত সুরুচিসম্পন্ন ভাব-প্রকাশের উপযোগী করে দেওয়া কিংবা সাধারণের অপরিচিত আভিধানিক শব্দের গুমর ভাঙিয়ে তাকে ঘরোয়া ব্যবহারে লাগানো যে কী কঠিন কাজ, আমাদের পক্ষে তা বোঝা সহজ নয়। বিদ্যাসাগর সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত; তাঁর রচনায় সংস্কৃত শব্দের প্রাচুর্য থাকা কিছুই বিচিত্র নয়।

কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এ বিষয়ে তাঁর কোন গোঁড়ামি ছিল না; বরং শব্দ প্রয়োগে আশ্চর্য সংগতিবোধ প্রকাশ পেয়েছে। একটি দৃষ্টান্ত দিলেই কথাটা স্পষ্ট হবে। ‘কথামালার’ গল্পে বলছেন— ‘‘এক দুঃখী নদীর তীরে গাছ কাটিতেছিল। হঠাৎ কুঠারখানি তাহার হাত হইতে ফস্কিয়া নদীর জলে পড়িয়া গেল।’’ সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতের পক্ষে এরূপ প্রাকৃত শব্দের (ফস্কিয়া) ব্যবহার তখনকার দিনে খুব সহজ বা স্বাভাবিক ছিল না। বেশ বোঝা যায়, শিল্পীর ন্যায় খুঁতখুঁতে মন নিয়ে বিচার-বিবেচনা করে শব্দ প্রয়োগ করেছেন। বিদ্যাসাগরের বাংলা রচনা পাঠ করে সেকেলে সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত অবজ্ঞা ভরে বলেছিলেন—ছাই লিখেছে, সবই তো বোঝা যায়। আজ যাঁরা বিদ্যাসাগরের ভাষাকে পন্ডিতি ভাষা বলে জাতে ঠেলেছেন তাঁরাও ভাষার ক্রমবিকাশ সম্পর্কে একই ধরনের ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করছেন।

তবে একথা স্বীকার করতে হবে, বাংলা গদ্য এখনও শুধু প্রয়োজনটুকু মেটাতেই ব্যস্ত, কোন প্রকার শখ মেটাবার কথা এখনও ভাবছে না। সোজা কথায় বাংলা গদ্য এখনও ঠিক সাহিত্যেরস্তরে এসে পৌঁছয়নি। প্রয়োজন ব্যতিরেকে মন যখন অকারণে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কথা বলবে এবং ভাষায় তা প্রকাশ করবে তখনই সাহিত্যের জন্ম হবে। ‘বর্ণপরিচয়’ থেকে শুরুকরে ‘বোধোদয়’, ‘কথামালা’, ‘আখ্যানমঞ্জরী’ প্রভৃতি পুস্তক প্রধানত বালক-বালিকাদের জন্য কিছু পাঠোপযোগী সামগ্রীর সংকলন। বঙ্কিমচন্দ্র এক সময়ে একটু অবজ্ঞার সুরে বলেছিলেন—ছেলেমেয়েদের উপযোগী কিছু পাঠ্যকেতাব ছাড়া বিদ্যাসাগর আর কি লিখেছেন? সংস্কৃত শব্দের আধিক্যবশত বিদ্যাসাগরের ভাষাও বঙ্কিমের ঠিক পছন্দসই ছিল না।

একথা ঠিক যে বালক বালিকাদের জন্য পুস্তক রচনা করেছেন প্রচুর কিন্তু ভুললে চলবে না যে ভাষার পথ নির্মাণে অগ্রসর হতে হতেই সাহিত্যের পথ উন্মুক্ত হয়েছে। বিদ্যাসাগর যখন তাঁর ‘শকুন্তলা’ এবং ‘সীতার বনবাস’ রচনা করেছেন সেই তখনই বাংলা গদ্যে প্রথম সাহিত্যের স্বাদ গন্ধ পায়ো গেল।

(ক্রমশ)