বাংলা গদ্যের ইতিবৃত্ত

পূর্ব প্রকাশিতর পর
বৃক্ষ-বল্কল তার বস্ত্র, গাছের ফলমূল তার খাদ্য—কখনো কাঁচা মাছ বা মাংস, কেননা রন্ধনবিদ্যা তখনো তার আয়ত্ত নয়. আবাসগৃহের দেয়াল তৈরি হয়েছে গাছের গুঁড়ি কিংবা পাথরের চাঁই সারিসারি সাজিয়ে, উপরে ডালপালার আচ্ছাদন। অনুমান করা অযৌক্তিক নয় যে আদি মানুষের জীবনযাত্রা যেমন ছিল অতি স্থূল শ্রীহীন, তার ভাষাও ছিল তেমনি স্থূল অমার্জিত। ভাষা কখনো জীবনকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না, জীবন যে-পরিমাণে পরিমার্জিত হবে, ভাষা সে-পরিমাণে পরিশোধিত হবে। সভ্যতার বিকাশে যেমন শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে গিয়েছে, ভাষার বিকাশেও ঠিক তাই।

সকল জিনিসেরই জন্মবৃত্তান্ত রহস্যাবৃত। মানুষ কোথায় পেল তার ভাষা? একটু ভাবলেই বোঝা যাবে যে মানুষ ভাষার প্রথম পাঠ নিয়েছে প্রকৃতির পাঠসালায়। প্রকৃতির রাজ্যে একটি শব্দের অর্কেস্ট্রা অবিরাম কর্ণগোচর— বাতাস বইছে শো শো শব্দে, জল ছুটে চলেছে কলকল রবে, বৃষ্টি পড়ছে ঝম ঝম করে, মেঘ ডাকছে গুরুগর্জনে, এমনি আরো কত বিচিত্র শব্দের সমাহার। ধ্বনি-মুখর প্রকৃতির নানা ধ্বনিকে মানুষ শব্দ তথা ভাষা রচনার কাজে লাগিয়েছে। আস্তে আস্তে ভাষার গাঁথুনি তৈরি হয়েছে। সহজে হয়নি। দুটি তিনটি শব্দ জুড়ে নিয়ে ভাব প্রকাশের আপ্রাণ চেষ্টা। একটি সুস্পষ্ট বাক্য রচনা করতে এক যুগ লেগে গিয়েছে। এ শুধু বাংলাভাষার কথা নয়, সব দেশের সব ভাষার শৈশব-ইতিহাসই এক।

এই য়ে শৈশবের কথা বলছি, ভাষার ঐ শৈশব কাটতে লেগে গিয়েছে শত শত বৎসর। ভাষা তখনো মুখের কথাতেই আবদ্ধ কেননা মানুষ তখনো নিরক্ষর, অক্ষর বা বর্ণমালার সৃষ্টিই হয়নি। আজকের মানুষ শিক্ষা শুরু করে বর্ণ-পরিচয় দিয়ে; আগেই বলেছি,, আদি মানুষের ভাষাশিক্ষা শুরু হয়েছিল শব্দ-পরিচয় দিয়ে। মানুষের অক্ষর-পরিচয় হবার আগে বাষা নিজেই ছিল নিরক্ষর। মুখের ভাষা মুখে মুখেই প্রচারিত ছিল। বহু যুগ পরে যখন বর্ণমালার সৃষ্টি হল তখন মুখের কথা লিপিবদ্ধ হল; ভাষা একটা স্থায়ী আশ্রয় পেল। এটা একটা মস্ত বড় ঘটনা; কেননা, যে জিনিস এতদিন ছিল কর্ণগোচর, এখন তা চক্ষুগোচর হল। ভাষার একটা চাক্ষুষ মূর্তি দেখা গেল। যেখানে মূর্তি সেখানেই মূর্তিপূজা। ভাষার আদর সমাদর অনেক বেড়ে গেল, সাজানো পরানো শুরু হল। উন্নতির সূচনা সেদিন থেকে। মুখের কথাকে লোকে আজও মূল্য দেয় না, লিখিতভাবে দিলে তবে তার মূল্য হয়। লিখিত ভাষার যে একটা মস্ত বড় সম্ভ্রম সেটা লোকে সেই তখন তেকেই বুঝে নিয়েছে। বুঝেছে যে কথাকে লোকসমক্ষে হাজির করতে গেলে যেমন-তেমনভাবে করলে চলবে না, দিব্যি সাজিয়ে-গুছিয়ে লোকরঞ্জন বেশে তাকে হাজির করতে হবে। দেখতে দেখতে ভাষার বেশভূষা, বদলাল, ভাব ভঙ্গিও বদলে গেল।
এতকাল মানুষ যে-ভাষায় কথা বলে আসছিল, ভাবল সেটা আটপৌরে, অন্দরমহলে যদি বা চলে, সদরে তা চলবে না। সেখানে একটু পোশাকি পরিচ্ছেদের প্রয়োজন হবে। দেখা দিল বাহারে রং-এর পোশাক, নাম হল পদ্য। এতকালের মুখে বলা আটপৌরে ভাষাটার নাম দিল গদ্য। অবশ্য এ নামকরণ চালু ছিল পন্ডিতমহলে; সাধারণ লোক লিখতে-পড়তে শেখেনি, গদ্যপদ্যের নামও শোনেনি। ফরাসি নাট্যকার মলিয়ের-এর নাটকে এক ব্যক্তি শুনে খুব অবাক হয়েছিলেন যে গত চল্লিশ বছর যাবৎ তিনি মুখে যে-কথা বলে আসছেন তাই নাকি গদ্য।
(ক্রমশ)