হীরেন্দ্রনাথ দত্ত
পূর্ব প্রকাশিতর পর
চতুর্দশ পঞ্চদশ শতকে ইয়োরোপের নানা দেশে নিজ নিজ ভাষায় বাইবল্-এর অনুবাদ হতে লাগল। সাধারণ মানুষ সেই প্রথম বাইবল্-এর মর্মকথা জানবার সুযোগ পেল। জার্মেন ভাষায় বাইবল্-এর অনুবাদ করেছিলেন স্বয়ং মার্টিন লুথার। রিফর্মেশন আন্দোলনের সৃষ্টি সেই তখন। রামমোহন-কৃত উপনিষদের অনুবাদকে বলা চলে আমাদের রিফর্মেশন আন্দোলনের সূচনা। তাঁর একেশ্বরবাদের প্রচারই প্রকৃতপক্ষে এ দেশের রিফর্মেশন আন্দোলন।
ইয়োরোপে রেনেসাঁস এবং রিফর্মেশন একই সঙ্গে পাশাপাশি চলছে। বঙ্গদেশেও এই দুই আন্দোলন একই সঙ্গে দেখা দিয়েছে। সমাজে প্রচণ্ড তোলপাড় ঘটেছে, ঘোরতর বাদানুবাদের সৃষ্টি হয়েছে। বদানুবাদের ফলে ভাষার পুষ্টিসাধন হয়েছে; কারণ যত বেশি তর্ক বিতর্ক হবে, ভাষা ততই সতর্ক এবং সপ্রতিভ হয়ে উঠবে। বাংলা গদ্যের পরম সৌভাগ্য যে জন্মক্ষণেই রামমোহনের ন্যায় যুক্তিবাদী মহামনস্বীর কাছে দীক্ষা লাভের সুযোগ সে পেয়েছে। আবার একই সঙ্গে ইংরেজি শিক্ষার কল্যাণে এসেছে নব যুগের বার্তা, মনের বদ্ধ দুয়ার গিয়েছে খুলে। এরই নাম রেনেসাঁস।
রামমোহনের অনতিকাল পরেই বিদ্যাসাগর। শৈশবেই এরূপ দুই মহামনস্বীর পরিচর্যা লাভ করা খুব কম ভাষা বা সাহিত্যের ভাগ্যেই ঘটেছে। দুজনেই সমান মনস্বী, সমান যুক্তিবাদী। চিন্তাশীল, যুক্তিবাদী, সংস্কারপন্থী মন সবসময়েই শান্তিভঙ্গকারী। সমাজের বেশির ভাগ মানুষই পরিবর্তন বিমুখ, যুগ যুগ লালিত রীতি প্রথা সমেত গতানুগতিক জীবন নিয়েই তারা তুষ্ট। রামমোহন, বিদ্যাসাগর প্রমুখ ব্যক্তিরা হঠাৎ নতুন কথা বলে তাদের অভ্যস্ত জীবনযাত্রায় আঘাত হানেন। এই সেদিন রামমোহন বলেছেন, সতীদাহ শাস্ত্র বিরুদ্ধ, আজ আবার বিদ্যাসাগর বলছেন, বিধবাবিবাহ শাস্ত্র সম্মত। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত, সনাতনপন্থীরা বিষম উত্তেজিত।
(ক্রমশ)