• facebook
  • twitter
Wednesday, 8 January, 2025

বাংলা গদ্যের ইতিবৃত্ত

এখানে মনে রাখা কর্তব্য যে বাংলা গদ্যের উন্নতি বিধানের উদ্দেশ্য নিয়ে রামমোহন বেদান্ত সূত্র অনুবাদে প্রবৃত্ত হননি। তাঁর উদ্দেশ্য অনেক বৃহৎ, অনেক ব্যাপক।

ফাইল চিত্র

হীরেন্দ্রনাথ দত্ত

পূর্ব প্রকাশিতর পর

এখানে মনে রাখা কর্তব্য যে বাংলা গদ্যের উন্নতি বিধানের উদ্দেশ্য নিয়ে রামমোহন বেদান্ত সূত্র অনুবাদে প্রবৃত্ত হননি। তাঁর উদ্দেশ্য অনেক বৃহৎ, অনেক ব্যাপক। তিনি ভেবে দেখেছেন যে আমাদের ধর্মগ্রন্থাদিতে যে সব উচ্চ আদর্শ, উচ্চ চিন্তা লিপিবদ্ধ আছে দেশের অগণিত অধিবাসী তার সঙ্গে পরিচিত নয়। বেদ উপনিষদ সমস্তই সংস্কৃত ভাষায় রচিত। দেশের ক’জন লোক তা পড়তে পারে, বুঝতে পারে? এ সব জিনিস বাংলায় অনুবাদ করে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে এনে দিতে হবে। নতুবা আমাদের নিজ ঘরে যে মহামূল্য রত্ন ভাণ্ডার সঞ্চিত আছে তা না জেনে না বুঝে দেশের বহু লোক ঝোঁকের মাথায় খ্রিস্টধর্ম অবলম্বন করবে। দেশবাসীকে দেশজ ধ্যান জ্ঞান শক্তি সাধনা সম্পর্কে অবহিত করবার জন্যেই তিনি লেখনী ধারণ করেছিলেন। প্রত্যক্ষভাবে বাংলা গদ্যের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন নি, কিন্তু পরোক্ষভাবে বাংলা গদ্য তাঁর রচনা দ্বারা প্রভূত পরিমাণে লাভবান হয়েছে।

বাংলা গদ্যের সেই শৈশব অবস্থায় রামমোহনের ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ রচনা এক অতি দুঃসাহসিক কাজ। গদ্য রচনা তো দূরের কথা অনভ্যাসবশত সাধারণ পাঠকের পক্ষে তখন বাংলা গদ্য ঠিক ভাবে পাঠ করাও দুঃসাধ্য ছিল। গ্রন্থের ভূমিকায় রামমোহন বলেছেন— ‘এতদ্দেশীয় অনেক লোক অনভ্যাস প্রযুক্ত দুই তিন বাক্যের অন্বয় করিয়া গদ্য হইতে অর্থবোধ করিতে হঠাৎ পারেন না… বাক্যের প্রারম্ভে আর সমাপ্তি এই দুইয়ের বিবেচনা বিশেষ মতে করিতে উচিত হয়।’’

এক বৎসর পরেই ১৮৬১ সালে প্রকাশিত হল রামমোহনের ‘ঈশোপনিষৎ’। ১৮১৯ সাল থেকে শুরুকরেছেন তাঁর সহ-মরণ-বিরোধী আন্দোলন। তাঁর ‘সহমরণ’ বিষয়ে প্রবর্ত্তক নিবর্ত্তকদের দ্বিতীয় সংবাদ’ থেকে কিয়দংশ উদ্ধৃত করছি— ‘‘অনেক কুলীন ব্রাহ্মণ যাঁহারা দশ পোনর বিবাহ অর্থের নিমিত্ত করেন, তাঁহাদের প্রায় বিবাহের পর অনেকেরসহিত সাক্ষাৎ হয় না, অথবা যাবজ্জীবনের মধ্যে কাহারো সহিত দুই চারিবার সাক্ষাৎ করেন, তথাপি ঐ সকল স্ত্রীলেকের মধ্যে অনেকেই ধর্ম্মভয়ে স্বামীর সহিত সাক্ষাৎ ব্যতিরেকেও এবং স্বামিদ্বারা কোন উপকার বিনাও পিতৃগৃহে অথবা ভ্রাতৃগৃহে কেবল পরাধীন হইয়া নানা দুঃখে সহিষ্ণুতাপূর্ব্বক থাকিয়াও যাবজ্জীবন ধর্ম্ম নির্ব্বাহ করেন, আর ব্রাহ্মণের অথবা অন্য বর্ণের মধ্যে যাহারা আপন ২ স্ত্রীকেলইয়া গার্হস্থ্য করেন, তাহাদের বাটীতে প্রায় স্ত্রীলোক কি ২ দুর্গতি না পায়? বিবাহের সময় স্ত্রীকে অর্দ্ধ অঙ্গ বলিয়া স্বীকার করেন, কিন্তু ব্যবহারের সময় পশু হইতে নীচ জানিয়া ব্যবহারকরেন; যেহেতু স্বামির গৃহে প্রায় সকলের পত্নী দাস্য বৃত্তি করে…।’’

রামমোহন কম করেও তিরিশ খানা পুস্তক পুস্তিকা রচনা করেছিলেন। ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ ‘ঈশোপনিষৎ’ইত্যাদি গ্রন্থ বাদ দিলে বেশির ভাগ পুস্তক পুস্তিকাই বাদ-প্রতিবাদ মূলক। যুক্তি বিচারের দ্বারা বিপক্ষের মত খণ্ডন করেছেন এবং যুক্তির দ্বারাই নিজ মতকে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করেছেন। যুক্তি তর্কের ব্যবহার ভাষার শক্তি যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে যে যুক্তির মধ্যে শক্তি যতখানি, স্বাদ গন্ধ ততখানি নয়। সেজন্যে রামমোহনের গদ্যে প্রসাদ গুণের কিঞ্চিৎ অভাব দেখা যায়। অবশ্য মনে রাখতে হবে যে তিনি সাহিত্য রচনার কথা ভাবেন নি; সমাজ সংস্কারের চিন্তাই তাঁর সমস্ত ক্ষণ সমস্ত মনকে ব্যাপৃত রেখেছিল। তাহলেও বলতে হবে রামমোহন অসাধ্য সাধন করেছেন।

(ক্রমশ)