হীরেন্দ্রনাথ দত্ত
পূর্ব প্রকাশিতর পর
ইংরেজি ভাষায় গদ্যের প্রচলন প্রথম হয়েছে চতুর্দশ শতকের শেষ ভাগে কিন্তু সংবাদপত্রের জন্ম হয়েছে অষ্টাদশ শতকে। দু’এর মধ্যে ব্যবধান প্রায় সাড়ে তিন শ’ বছরের। আমাদের প্রথম গদ্য গ্রন্থের প্রকাশ ১৮০১ সালে; মাত্রসতেরো বৎসর পরে ১৮১৮ সালে আমাদের প্রথম সংবাদ পত্রের প্রকাশ অতি বিস্ময়কর ঘটনা বলতে হবে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে শ্রীরামপুর থেকে ‘সমাচার দর্পণ’ প্রকাশের কয়েক সপ্তাহ পরেই কলকাতা থেকে প্রকাশিত হল ‘বাঙ্গাল গেজেটি’ নামে অপর এক বাংলা সংবাদপত্র। প্রথমটির প্রতিষ্ঠা মিশনারী সাহেবদের হাতে, দ্বিতীয়টি পুরোপুরি বাঙালির হাতে গড়া। প্রতিষ্ঠাতা গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য ও হরচন্দ্র রায়। বাংলা গদ্যের জন্মটা হয়েছে বিলম্বে কিন্তু একবার যাত্রা শুরু করে পথে একটুও গড়িমসি করে নি, অগ্রসর হয়েছে বিদ্যুৎ গতিতে।
উইলিয়াম কেরির প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেও বলতে হবে যে তাঁর নেতৃত্বের এবং ইংরেজ উদ্যমের এখানেই অবসান হয়েছে। এরপরে বাংলা গদ্যের যে অগ্রগতি হয়েছে, তা সম্পূর্ণরূপে বাঙালির নিজস্ব প্রতিভাবলে। বাংলা গদ্যের জন্মটি হয়েছে অতি শুভ লগ্নে। লগ্নপতি স্বয়ং রাজা রামমোহন। ১৮১৪ সালে রাজা রামমোহন রায় কলকাতায় এসে স্থায়ীভাবে এখানে বসবাস শুরু করেন। এক যুগের অবসান হয়ে নতুন যুগের আগমন সূচিত হয়েছে। এই যুগান্তরের উপলব্ধি এ মানুষটির মনে যেমনভাবে হয়েছে সারা দেশে তেমন আর কারও মনে নয়। স্পষ্টত বুঝতে পেরেছিলেন যে দেশময় মস্ত বড় একটা তোলপাড় হবে। নতুনে পুরাতনে দ্বন্দ্ব বাঁধবে। নতুনের সবই গ্রহণীয় নয়, পুরাতনেরও সবই বর্জনীয় নয়। দেশের মানুষকে এক বিরাট পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। সে যেন নিতান্ত দিশেহারা না হয়। রামমোহন দেখছেন, ইংরেজ একদিকে এনেছে নতুন যুগের বার্তা, অপরদিকে এক নতুন ধর্মের বাণী। মিশনারি সাহেবরা প্রচার কার্য শুরু করেছেন। তাঁরা খ্রিস্ট ধর্মকে বড় করবার জন্যে হিন্দু ধর্মকে হেয় করবার চেষ্টা করছেন। হিন্দু ধর্ম বিরোধী মিথ্যা প্রচারের প্রতিবদে রামমোহন নানা পুস্তক পুস্তিকা প্রণয়ন করে প্রচার করতে লাগলেন। তার চাইতে ঢের বড় কথা, ১৮৫১ সালে প্রকাশিত হল রামমোহনের প্রথম পুস্তক ‘বেদান্ত গ্রন্থ’।
(ক্রমশ)