হীরেন্দ্রনাথ দত্ত
পূর্ব প্রকাশিতর পর
১৮১৮ সাল থেকে ১৮২৫ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে দুই খন্ডে সমাপ্ত কেরি-কৃত বাংলা অভিধান। এ ছাড়া ১৮৩৪ সালে তাঁর মৃত্যুর পূর্বে সমগ্র বাইবল্-এর (ওল্ড এবং নিউ টেস্টামেন্ট সমেত) অনুবাদ সমাধা করে একটি সংশোধিত সংস্করণ তিনি প্রকাশ করে গিয়েছেন। কেরি-কৃত বাইবল্ অনুবাদের অংশবিশেষ—‘‘অতএব এই মত প্রার্থনা কর হে আামাদের স্বর্গস্থ পিতা তোমার নাম পবিত্ররূপে মান্য হউক। তোমার রাজ্যের আগমন হউক। যেমন স্বর্গে তেমন পৃথিবীতে তোমার ইষ্টক্রিয়া করা যাউক। অদ্য আমাদের নিত্য ভক্ষা আমারদিগকে দেও। এবং যেমন আমরা আপনাদের ঋণধারির দ্বিগকে মাফ করি সেই মত আমারদের ঋণ মাফ কর। এবং আমারদিগের পরীক্ষায় চালাইও না কিন্তু আমারদিগকে আপদ হইতে পরিত্রাণ কর কেননা সদ্য সর্ব্বক্ষণে রাজ্য ও শান্তি ও গৌরব তোমার। আমিন।’’
কেরি এদেশে এসেছেন ১৭৯৩ সালে। এসেছিলেন খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে। সে-কাজ সাধ্যমতো অবশ্যই করেছেন; এবং সে-কাজ করতে গিয়েই ১৭৯৩ থেকে ১৮৩৪ সাল অবধি সুদীর্ঘ একচল্লিশ বৎসরকাল তিনি যে নিষ্ঠার সঙ্গে বাংলাভাষার সেবা করে গিয়েছেন তা আমাদের ভাষার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা উচিত। সত্যি বলতে কি, বাংলা গদ্যের ভিতটি গড়ে দিয়েছেন প্রধানত কেরি সাহেব। স্বদেশীয় পন্ডিতরা কাজ করেছেন তাঁরই পরিচালনায় এবং নির্দেশনায়। খ্যাতনামা পন্ডিত ডক্টর সুশীলকুমার দে বলেছেন— “To Carey belongs the credit of having raised the language from its debased condition of an unsettled dialect to the character of a regular and permanent form of speech capable of becoming the refined and comprehensive vehicle of a great literature in the future.”
অবশ্য এ কথা স্বীকার করতে হবে যে এ যাবৎ যা হয়েছে তা ঐ ভিতটুকুই অর্থাৎ বাক্য গঠনের চর্চা, কোনো প্রকারে কষ্টেসৃষ্টে ভাব প্রকাশের চেষ্টা। সোজা কথায়, ভাষা ব্যবহারের প্রথম পাঠ। সাহিত্য সৃষ্টির প্রশ্নই ওঠে না। কেরি-নিযুক্ত পন্ডিত মুনশিদের মধ্যে একমাত্র মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের লেখায় কখনো সখনো একটু প্রসাদগুণ প্রকাশ পেয়েছে। আমাদের দেহে যেমন ভাষার দেহেও তেমনি আছে হাড় মাস মজ্জা। প্রত্যেক ভাষাতেই ইডিয়াম বলে একটা জিনিস আছে। ঐ ইডিয়ামই হচ্ছে ভাষার মজ্জা। লোকসংস্কৃতি বা জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবন থেকে ঐ ইডিয়ামের উৎপত্তি। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত। তাঁর বহু রচনা সংস্কৃত থেকে অনুবাদ বা শাস্ত্রালোচনা। (ক্রমশ)