হীরেন্দ্রনাথ দত্ত
পূর্ব প্রকাশিতর পর
উল্লেখযোগ্য যে ঐ উদ্ধৃত অংশগুলি বাংলা হরফে ছাপা অর্থাৎ বাংলা হরফের মুদ্রিত নমুনা ঐ গ্রন্থেই সর্বপ্রথম দেখা গিয়েছে।
কিছুকাল পরে শ্রীরামপুরে মিশনেও একটি ছাপাখানা স্থাপিত হল। শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে ছাপা প্রথম বাংলা গ্রন্থটি হল— ‘মঙ্গল সমাচার মাতিউর রচিত’ (Gospel of St. Matthew)। অনুবাদক উইলিয়াম কেরি ও তাঁর সহকর্মী পাদ্রি টমাস। অনেকের ধারণা গ্রন্থ রচনার কাজে তাঁরা রামরাম বসুর সাহায্য নিয়েছিলেন। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৮০০ সালের আগস্ট মাসে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে কেরি-কৃত সমগ্র নিউ টেস্টামেন্ট-এর অনুবাদ এবং মুদ্রণকার্য সম্পন্ন হল ১৮০১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।
প্রায় একই সময়ে কেরি একখানা ব্যাকরণও রচনা করেছেন। বাংলাভাষার প্রতি তাঁর অনুরাগ এবং আস্থা কত গভীর তা প্রকাশ পেয়েছে ঐ বইটির ভূমিকায়। বলছেন, “The language is peculiarly copious and harmonious; and were it properly cultivated, would be deserving a place among those which are accounted the most elegant and expressive…”। কেরির এই উক্তিটি ভাষার গুণাগুণ বিচারে তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচায়ক।
দুই
বাংলা গদ্যের চর্চা এবং রচনার কাজ সুপরিকল্পিতভাবে শুরু হল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের উদ্যোগে এবং উইলিয়াম কেরির পরিচালনায়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠা ১৮০০ সালের মে মাসে কলকাতার লালবপাজার অঞ্চলে। কেরি কলেজের কাজে যোগদান করেন ১৮০১ সালে। বাংলা এবং সংস্কৃত বিভগের দায়িত্ব ছিল তাঁর উপরে ন্যস্ত। কেরির প্রথম কাজই হল ইংরেজ-কর্মচারিদের জন্যে পঠনযোগ্য কিছু পুস্তক রচনা করা। বাংলা এবং সংস্কৃতের অধ্যাপক পদে যেসব দেশীয় পণ্ডিতকে নিযুক্ত করেছিলেন তাঁরাই হলেন এ কাজে তাঁর প্রধান সহায়। প্রথম বৎসরেই ১৮০১ সালে প্রকাশিত হল রামরাম বসু প্রণীত ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’। বাঙালি গ্রন্থকার রচিত বাংলা হরফে মুদ্রিত এটিই প্রথম বাংলা গদ্যগ্রন্থ। এই কারণে এ গ্রন্থটির একটি ঐতিহাসিক মূল্য আছে।
প্রথম বাংলা গদ্যগ্রন্থে ব্যবহৃত ভাষা সম্পর্কে কৌতূহল থাকা স্বাভাবিক। গ্রন্থের কয়েক পঙক্তি নমুনাস্বরূপ উদ্ধার করা যেতে পারে— ‘‘রাজা প্রতাপাদিত্য মহারাজা হইলেন। তাঁহার রাণী মহারাণী। বঙ্গভূমি অধিকার সমস্তই তাহারি করতলে। এই মত বৈভবে কতক কাল গত হয়। রাজা প্রতাপাদিত্য মনে বিচার করেন আমি একছত্রী রাজা হইব এ দেশের মধ্যে কিন্তু খুড়ো মহাশয় খাকিতে হইতে পারে না। ইহার মরণের পরে ইহার সন্তানদিগকে দূর করিয়া দিব। তবেই আমার একাধিপত্য হইল। এখন কিছুকাল ধৈর্য্য অবলম্বন কর্ত্তব্য। এই মতে ঐশ্বর্য্য পর ২ বৃদ্ধি হইতেছে।…’’
‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’র পরে রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় রচিত ‘মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং’ (১৮০৫) নামক গ্রন্থটিও এই সূত্রে স্মরণীয়। রামরাম বসুর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘লিপিমালা’ প্রকাশিত হয়েছে ১৮০২ সালে। প্রথম দিকের এসব গ্রন্থ কি উদ্দেশ্য নিয়ে রচিত বসু মহাশয় সে কথাটি খুব স্পষ্ট করেই ‘লিপিমালা’র ভূমিকায় ব্যক্ত করেছেন। এখানে তার খানকটা অংশ উদ্ধৃত করছি— ‘‘এখন এ স্থানের অধিপতি ইংলন্ডীয় মহাশয়রা তাহারা এ দেশীয় চলন ভাষা অবগত নহিলে রাজ ক্রিয়াক্ষম হইতে পারেন না ইহাতে তাহারদিগের আকিঞ্চন এখানকার চলন ভাষা ও লেখাপড়ার ধারা অভ্যাস করিয়া সর্ব্বাবিধ কার্য্য ক্ষমতাপন্ন হয়েন।…’’
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারও তাঁর অন্যতম গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, যুবক সাহেবজাতগণের শিক্ষার নিমিত্ত। কাজেই বাংলা গদ্যের সূচনা যে প্রধানত ইংরেজের প্রয়োজনে এবং ইংরেজের উদ্যোগেই হয়েছিল সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। প্রথম যুগের গদ্য রচয়িতাদের মধ্যে সবচাইতে প্রতিভাবান ব্যক্তি মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার।
(ক্রমশ)