হীরেন্দ্রনাথ দত্ত
পূর্ব প্রকাশিতর পর
দলিল-দস্তাবেজের নমুনা দেবার প্রয়োজন বোধ করি না। তবে অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত ‘মহারাজ বিক্রমাদিত্য চরিত্র’ নামক গদ্য-গল্প থেকে অংশ-বিশেষ উদ্ধৃত করছি— ‘শ্রীযুত ভোজ রাজা তাহার কন্যা শ্রীমতি মৌনাবতি সোড়ষ বরিস্যা বড় ষুন্দরি মুখ চন্দ্র তুল্য কেষ মেঘের রঙ্গ চক্ষু আাকর্ন্ন পর্যন্ত যুঙ্গ্য ভ্রুর ধনুকের নেয়ার ওষ্ঠ নক্তিমে বর্ণ্ণ হস্ত পদ্মের মৃণাল স্তন দাড়িম্ব ফল রূপলাবণ্য বিদ্যুৎছটা তার তুলনা আর নাঞী। কন্যা পণ করিয়াছে রাত্রের মধ্যে জে কথা কহাইতে পারিবেক তাহাকে আমি বিভা করিব।…’’
এ সব নিদর্শন থেকে বাংলা গদ্যের অস্তিত্বটুকুই শুধু প্রমাণিত হচ্ছে, তার বেশি কিছুই নয়। ইতিহাস রচিত হয় কৃতিত্ব দিয়ে, অস্তিত্ব দিয়ে নয়। সে-ইতিহাসের শুরু ফোর্ট উইলিয়ামকলেজে। এখানে একটি কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। বাংলাভাষার নিজস্ব কিছু মাহাত্ম্য বোধ করি আছে। দেখা যাচ্ছে বিদেশীরা অতি সহজেই এ ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। পর্তুগিজরাও ইংরেজদের ন্যায় বাণিজ্যের লোভে এ দেশে এসেছিল। তারাও বিশেষ করে পর্তুগিজ মিশনারিরা আগ্রহের সঙ্গে বাংলা শিখেছেন এবং বাংলাভাষায় তাদেরও কিছু অবদান আছে। পর্তুগিজ উদ্যোগে রচিত তিনখানা মাত্র গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে— দোম আন্তোনিয়ার ‘ব্রাহ্মণ-রোমান ক্যাথলিক সংবাদ’; মনোএল দা আস্সুম্পাসাঁউ এর ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থ’, ভেদ’ এবং তাঁরই রচিত বাংলা ব্যাকরণ।
প্রথম গ্রন্থটির রচয়িতা দোম আন্তোনিয়ো বাঙালি, পূর্ববঙ্গের এক জমিদার পুত্র। পর্তুগিজ পাদ্রি কর্তৃক তিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিকে রচিত ‘ব্রাহ্মণ-রোমান ক্যাথলিক সংবাদ’ গ্রন্থটিই বোধকরি বাংলায় রচিত সর্বপ্রথম গদ্যগ্রন্থ। পর্তুগিজ পাদ্রি রচিত ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থ ভেদ’ বাংলাভাষায় প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ। ১৭৪৩ সালে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন শহরে রোমান হরফে মুদ্রিত। বাঁ দিকের পৃষ্ঠায় বাংলা অনুবাদ, ডান দিকের পৃষ্ঠায় মূল পর্তুগিজ রচনা। গ্রন্থটির ভাষা সম্পর্কে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন— ‘‘এই ভাষায় যথেষ্ট ফিরিঙ্গিয়ানা দোষ আছে। কিন্তু গুণও যথেষ্ট আছে।… বহু স্থানে পাদ্রি সাহেব বেশ ঝরঝরে বাঙ্গলা লিখিয়াছেন। তাঁহার রচনা-শৈলী একেবারে কথাবার্তার অনুকারী। …ছোট ছোট বাক্যে ঘরোয়া কথা পাদ্রি সাহেব যেখানে বলিয়াছেন, সেখানকার রচনা বাস্তবিকই প্রাসাদগুণযুক্ত…।’’ বাংলা ব্যাকরণখানাও পাদ্রি মনোএল-দা-আসসুম্পসাঁউ কর্তৃক রচিত। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এটিই বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ। এ গ্রন্থটির জন্যও তিনি সুনীতিবাবুর প্রশংসা লাভ করেছেন। বলেছেন— ‘বাঙ্গালার প্রথম ব্যাকরণকার ও কোষকার বলিয়া উচ্চস্থান তাঁহার প্রাপ্য।’
বাংলা গদ্যে পর্তুগিজ উদ্যম এখানেই শেষ হয়েছে। এদিকে ১৭৭৮ সালে ইংরেজ মিশনারিদের উদ্যোগে মুদ্রাযন্ত্র স্থাপিত হয়েছে হুগলি শহরে। ঐ বৎসরেই ১৭৭৮ সালে হুগলির মুদ্রাযন্ত্রের মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হল হ্যালহেড সাহেবের A Grammar of the Bengal Language। বইটি ইংরেজিতে লেখা, নিঃসন্দেহে ইংরেজ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে রচিত। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে কোনো কোনো কথার উদাহরণ হিসাবে গ্রন্থকার কৃত্তিবাসের রামায়ণ, কাশীরাম দাসের মহাভারত এবং ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করেছেন।
(ক্রমশ)