তামিলনাড়ু যদি পারে আমরা কেন পারি না

প্রতীকী চিত্র

প্রবীর মজুমদার

ভারতে থাকতে হলে হিন্দি বলতেই হবে? বাংলা বলতে হলে বাংলাদেশ যেতে হবে? বাংলার মাটিতে বাংলা বলার জন্য, হিন্দি না বলার জন্য বাঙালিকে ‘বাংলাদেশী’ বলল এক বহিরাগত। সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল ভিডিওর কল্যাণে এই সম্পর্কে এখন অনেকেই অবগত হয়ে গিয়েছেন। খোদ কলকাতায় দাঁড়িয়ে একজন বাঙালি ভদ্রমহিলাকে হিন্দির ব্যবহার নিয়ে রাজস্থানের তরুণী যেভাবে আক্রমণ করলেন, তাতে বাঙালি হিসাবে আমাদের রাজ্যে আমাদের ভাষিক অস্তিত্ব যে সার্বিকভাবে সংকটাপন্ন, তা নিয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। কী আশ্চর্য ঔদ্ধত্যের মেজাজে ওই তরুণী একজন কলকাতাবাসীকে বলে দিলেন ‘আপ বাংলাদেশ মে নহি হো, ইউ আর ইন ইন্ডিয়া! ইন্ডিয়া মে হো না? হিন্দি নহি আতা?ওয়েস্ট বেঙ্গল ইজ আ পার্ট অফ ইন্ডিয়া, ইউ মাস্ট বি লার্নিং হিন্দি! দ্য মেট্রো ইজ নট ইয়োর্স, ওয়েস্ট বেঙ্গল ইজ নট ইয়োর্স।’

সাংবিধানিক ভাষা সম্পর্কে ওই তরুণীর অজ্ঞতা প্রমাণিত। বয়োজ্যেষ্ঠ্যা একজন অচেনা সহযাত্রীর সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, সেই সহবতও তো তাঁর নেই। পুরো সময় জুড়ে তিনি ধৃষ্টতার সুরে কথা বলে গেলেন। অন্য ভাষাভাষী মানুষের প্রতি অসীম বিদ্বেষ না থাকলে এমনটা সম্ভব নয়। এত অল্প বয়সেই ভিনরাজ্যের শহরে মেট্রো রেলের মতো সর্বসাধারণের ব্যবহারযোগ্য জায়গায় ওই তরুণী যেভাবে এ ধরনের ঘৃণা ছড়ালেন এবং তাতে অনুতপ্ত হয়েছেন বলেও খবর নেই – এইটেই আতঙ্কের।


তার আগে বাংলার মফস্বলের পরিযায়ী শ্রমিককেও কাজের সূত্রে ভিনরাজ্যের শহরে গিয়ে বাংলা বলার কারণে ‘বাংলাদেশি’ শুনতে হয়েছে। এতদিন এসব ঘটনা আমাদের গা-সওয়া ছিল, কিন্তু কলকাতার মানুষকে কলকাতাতেই হিন্দি না বলার জন্য ‘বাংলাদেশি’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে – এ আমাদের শহরকেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে সেদিন অবধিও কল্পনাতীত ছিল। এমন নয় যে কলকাতায় এরকম হিন্দি আধিপত্যবাদের কথা আগে শোনা যায়নি। যে ঘটনা নিয়ে আলোচনা, সেরকম ঘটনা ইদানীং যে আকছার ঘটে চলেছে।

কয়েক শতাব্দী ধরে চলা ইউরোপিয় সাম্রাজ্যবাদী অনুশীলনের অন্যতম স্তম্ভই ছিল সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ। কত যে পরাধীন জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ধারাবাহিক ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হয়েছে, নষ্ট হয়ে গিয়েছে কত ভাষা! রাজ্যপাট জারি রাখার জন্য সে শূন্যস্থানের সুযোগে দিব্যি নিজেদের ভাষা চাপিয়ে দিতে পেরেছে বিপুল ক্ষমতাধর, বহিরাগত শক্তি। ঔপনিবেশিক শাসন শেষ হওয়ার পরেও যে আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার দেশগুলির সরকারি ভাষার তালিকায় ইংরাজি, স্প্যানিশ পর্তুগিজ বা ফরাসির নামই চোখে পড়ে, তার অবশ্যম্ভাবী শিকড় ওই অন্ধকার অতীতেই।

ভারতীয় উপমহাদেশের পরিস্থিতি আফ্রিকার মত হয়নি। এখানে অন্তত নাগরিক পরিসরে ভাষা বা ভাষাগোষ্ঠীর অমন বিস্তৃত ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেনি বটে, উলটে কাজের সুবিধার্থে বাংলা বা হিন্দির মতো দেশিয় ভাষা শেখার উৎসাহ দেখা যেত নবাগত ব্রিটিশদের মধ্যে। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত ‘ওয়ার্কিং ল্যাঙ্গুয়েজ’ হিসাবে যে ইংরিজিই প্রাধান্য পেল, সাহিত্যভারে কুলীন বাংলা, মারাঠি বা তামিলের ভাগ্যে সে শিকে ছিঁড়ল না – তা নিয়ে আম ভারতবাসী যে খুব অখুশি ছিল, তাও নয়। পাশ্চাত্যের ভাষা শিক্ষিত ভারতীয়কে শেক্সপিয়র চিনিয়েছিল, মিলটন,ওয়ার্ডসওয়ার্থ, বায়রন, কিটস পড়িয়েছিল। বিশ্ব রাজনীতির দুনিয়া উন্মুক্ত হয়েছিল মুক্তিকামী যুবসমাজের কাছে। এমনকি প্রজন্মের পর প্রজন্ম উচ্চবর্ণের সীমাহীন অত্যাচারে অতিষ্ঠ নিম্নবর্ণের মানুষকে ভরসাও দিয়েছিল ইংরিজি শিক্ষাই। একথা তো কোনোভাবেই আজ অনস্বীকার্য নয়, যে ইংরিজি ছিল বলেই ভীমরাও আম্বেদকরের মত দলিত সমাজের উজ্জ্বল উদ্ধারকে রাজনীতির জগতে পেয়েছিল আধুনিক ভারত।

বাঙালি সেইসময় নিজেকে ব্রিটিশের সমকক্ষ ভাবতে শুরু করেছিল জাতি হিসাবে চোস্ত ইংরিজি বলায় তারাই প্রথম সারিতে থাকতে পেরেছিল বলে। কংগ্রেসের প্রথম কয়েক দশকের ইতিহাসে ইংরিজি বাদ দিয়ে অন্য কোনো ভাষায় বক্তৃতা করার কথা ভাবতেই পারেননি উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি বা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির মত নেতারা। দেশের মানুষের কাছে পৌঁছতে হলে দেশের মানুষের ভাষায় কথা বলতে হবে – এই দাবি তুলে এ নিয়মের প্রতিবাদ এসেছিল যাঁর তরফে, তিনি কোনো রাজনৈতিক হোমরা-চোমরা ছিলেন না, তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ভাষার প্রাধান্যের এই চিত্রটা খুব স্বাভাবিকভাবেই বদলাতে শুরু করেছিল ঔপনিবেশিক শাসনের শেষ পর্যায়ে এসে। ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে সর্বভারতীয় ঐক্যের সেতু হিসাবে হিন্দি ভাষাকে ব্যবহার করার একটা উদ্যোগ কংগ্রেসি নেতাদের তরফ থেকেই ছিল। বিশেষত দক্ষিণ ভারতের হিন্দি-অপ্রতুল অঞ্চলে হিন্দির প্রচারকে পাখির চোখ করেছিল কংগ্রেস। স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী ১৯১৮ সালে তৈরি করেছিলেন দক্ষিণ ভারত হিন্দি প্রচার সভা। তারপর ১৯২৫ সালেই উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি- সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির হাতে গড়া ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সরকারি ভাষা ইংরিজি থেকে হিন্দি হয়ে গেল। ১৯৪২ সালে যখন হিন্দু-মুসলমান অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে, প্রবল হয়ে উঠছে পৃথক পাকিস্তানের দাবি, ধর্মনিরপেক্ষতায় বাঁধতে হিন্দি-উর্দু- দুই উত্তর ভারতীয় ভাষাকে পাশাপাশি রেখে গান্ধীজী তৈরি করলেন হিন্দুস্তানী প্রচার সভা।তারও চারবছর পর, ভারত ভাগ যখন একপ্রকার নিশ্চিত, সংবিধান পরিষদের উল্লেখযোগ্য সদস্য পণ্ডিত রঘুনাথ বিনায়ক ধুলেকর ১০ ডিসেম্বর ১৯৪৬ সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন ‘যাঁরা হিন্দুস্তানী জানেন না, তাঁদের ভারতে থাকার কোনও অধিকার নেই। যাঁরা এখানে সংবিধান তৈরি করতে এসেছেন অথচ হিন্দুস্তানী জানেন না, তাঁরাও এই পরিষদে থাকার যোগ্য নন।’ সংবিধান পরিষদে রঘুনাথ ধুলেকর তো বটেই, বালকৃষ্ণ শর্মা, পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডন, বাবুনাথ গুপ্তা, রবিশঙ্কর শুক্লা, শেঠ গোবিন্দ দাস, সম্পূর্ণানন্দ, কানহাইয়ালাল মানেকলাল মুন্সির মতো হিন্দিবাদীদের আগ্রাসী উপস্থিতি সত্ত্বেও হিন্দি যে জাতীয় ভাষা হয়ে উঠতে পারেনি তার পিছনেও মাদ্রাজের সদস্যদের অনড় অবস্থানের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। প্রায় তিনবছর তর্কাতর্কি চলার পর অবশেষে যে সমঝোতার সিদ্ধান্ত হয়, সংবিধানের ১৭ নম্বর ভাগে ইংরিজির সঙ্গে দেবনাগরী লিপির হিন্দিকে কেবল ‘আরেকটি সরকারি ভাষা’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, একক জাতীয় ভাষা হিসাবে নয়। প্রসঙ্গত, হিন্দিকে জাতীয় ভাষা বা রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে সোচ্চার সওয়াল যাঁরা করেছেন, সেই তালিকায় একজন উল্লেখযোগ্য বাঙালি রাজনীতিবিদও ছিলেন। তাঁর নাম শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।

ইতিহাসের অদ্ভুত পরিহাসে, একসময় যে ইংরিজি ছিল পাশ্চাত্য উপনিবেশবাদের ভরসার খুঁটি, পরবর্তীকালে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে অহিন্দিভাষীদের কার্যকরী অস্ত্র হয়ে উঠল সেই বিদেশি ভাষাই। হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সচেতন প্রতিবাদের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার উত্তরাধিকার বলতে গেলে একটি রাজ্যেরই – মাদ্রাজ বা তামিলনাড়ু।
বাংলায় হিন্দি প্রভাবের পরিস্থিতি অবশ্য অনেকটা আলাদা। এখানে প্রতিবাদের ইতিহাসও তামিলনাড়ুর তুলনায় নবীন। আটের দশকে আনন্দমার্গী প্রভাতরঞ্জন সরকারের মতাদর্শ অনুসারী আমরা বাঙালি দলের কিছু কাজ নজর কেড়েছিল। এই দল বেশকিছু পঞ্চায়েতে আসনও জিতেছিল। আমরা বাঙালির পরে এ ধরনের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ধারায় দ্বিতীয় নাম বলতে এই শতাব্দীর ‘বাংলা পক্ষ’।

আজ স্বাধীনতার ৭৮ বছর পর পরে হিন্দি না জানা নাগরিককে যখন প্রায়ই পরদেশি বলে কোণঠাসা করা চলছে, আর তাতে মদত দিয়ে চলেছে রাষ্ট্র, তখন এই প্রতিধ্বনির ইতিহাস ফিরে দেখার প্রয়োজন পড়ে বৈকি।পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসের বড় বড় পদে হিন্দিভাষী কর্মীর সংখ্যা দিনকে দিন কীভাবে বাড়ছে, তার সঠিক তথ্যভাণ্ডার এখনো তৈরি হয়নি বটে, কিন্তু চোখকান খোলা রাখলেই টের পাওয়া যায়। নিশ্চিতভাবে এর পিছনে সংঘ পরিবারের বৃহৎ পরিকল্পনা কাজ করছে। সংঘ পরিবার যে নিজেদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যে স্থির থাকতে পারে – গত ১০০ বছরের ইতিহাসে এই গুণের প্রমাণ তারা বারবার দিয়েছে। এর বিরুদ্ধে কোনো জোরালো রাজনৈতিক প্রতিবাদ উঠে আসছে না তাতেই বোঝা যায়, তামিলনাড়ু কেন পারে আর আমরা কেন পারি না।

বাংলাভাষার সমস্যা বাঙালির প্রধান সমস্যা না হয়ে পারে না। কারণ বাঙালি হওয়ার প্রাথমিক শর্তটাইতো তার ভাষা। বাংলা ভাষা কাজের ভাষা না থাকলে, এই ভাষায় ক্রমে আড্ডাও উঠে যাবে। অন্য ভাষায়, যা বাঙালির নিজের ভাষা নয়, সেই ভাষায় বাঙালি অবশ্যই পিছিয়ে যাবে, সেই ভাষা যাদের মাতৃভাষা, তাদের কাছে। সুতরাং বাংলা ভাষায় কথা বলা মানুষদের বাস্তব সমস্যাগুলোর বাস্তব সমাধান ছাড়া, ভাষা নিয়ে আবেগি চর্চা অরণ্যে রোদনে পরিণত হতে বাধ্য।