অসমকে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে বিজেপি-সঙ্ঘ পরিবার। রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতিতে এমন আশঙ্কাই তৈরি হচ্ছে। যে বিধানসভায় দাঁড়িয়ে পক্ষপাতহীনভাবে রাজ্যের প্রতিটি জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সুরক্ষিত করার শপথ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসেছিলেন, সেখানেই নিজের গলার শিরা ফুলিয়ে বললেন, ‘আমি পক্ষ নেবই এবং নিম্ন অসমের মিয়া মুসলিমদের (বাঙালি মুসলমান) উজান অসমে আসতে দেব না।’
গত লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকেই হিমন্ত বিশ্বের এই ধরনের মন্তব্য লাগামহীন হয়ে উঠেছে। গত সপ্তাহে নগাঁও জেলার ধিং-এ এক নাবালিকার দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনাকে হাতিয়ার করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বেপরোয়া ঘৃণা প্রচারে নেমে পড়েছেন শর্মা। তবে এতদিন বিধানসভার বাইরে এ ধরনের মন্তব্য করতেন, কিন্তু এবার যাবতীয় রীতি, বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে বিধানসভার ভেতরেই মুসলিমদের বিরুদ্ধে কুৎসিত আক্রমণ হানলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর পদ ও বিধানসভার মর্যাদা— দুটোই কলঙ্কিত করলেও তাতে যে তাঁর কিছুই যায় আসে না, তা শারীরিক ভঙ্গিতেই বুঝিয়ে দেন শর্মা।
বিধানসভায় দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার মুসলিম-বিদ্বেষী মন্তব্যের ফলে রাজ্যে সংখ্যালঘুদের উপর বেপরোয়া আক্রমণ নেমে আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ধিং কাণ্ডকে হাতিয়ার করে মুখ্যমন্ত্রীর মুসলিম-বিদ্বেষী মন্তব্যে গত চার-পাঁচদিন ধরে উজান অসমের বিভিন্ন জেলায় উত্তেজনা ছড়িয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে মুসলিমদের উজান অসম ছাড়ার হুমকি দিয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলি। উন্মত্ত একদল যুবক মুসলিম দেখলেই মারধর করছে। নাজিরায় একটি সরকারি প্রকল্পের কাছে জড়িত ১২ জন মুসলিম নির্মাণ শ্রমিকদের মজুরি না দিয়ে অর্ধনগ্ন করে পিটিয়ে তাড়িয়ে দেন শিবসাগর জেলা বিজেপি সভাপতি ময়ূর বরঠাকুর। উজান অসমে নির্মাণ কাজে, দোকান কর্মচারী, গাড়ি চালকের কাজে মুসলিমদের রাখা যাবে না বলে ফরমান দিয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলি। এদের মূল লক্ষ্য, গরিবের কাজ কেড়ে নেওয়া।
রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় মুসলিম খেদাও আন্দোলন শুরু হয়েছে। বিশেষ করে গরিব অংশের মুসলিমদের এক সপ্তাহের মধ্যে রাজ্য ছাড়তে প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে চলেছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির সদসরা। উজান অসমের শিবসাগর, নলবাড়ি, জোড়হাট, কামরূপ ইত্যাদি জেলার মুসলিমদের উপর দৈহিক আক্রমণ, বাড়িঘর ভাঙচুরের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। উগ্র জাতীয়তাবাদী সংগটনের নেতারা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বসে মুসলিম তাড়ানোর হুমকি দিচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ভয়ভীতি ছড়ানো হচ্ছে। অথচ পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক ছড়িয়েছে শিবসাগর জেলায়।
এসব কাণ্ডের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকে দায়ী করেছে বিরোধী দল ও সংগঠনগুলি। মুসলিমদের বিরুদ্ধে নিয়মিত কুৎসা আক্রমণ করছেন মুখ্যমন্ত্রী শর্মা। কিছুদিন আগে গুয়াহাটি মহানগর থেকে মুসলিম চালকদের তাড়ানোর হুমকি দিয়েছিলেন। গুয়াহাটিতে কৃত্রিম বন্যার জন্য মেঘালয়ে এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিককে দায়ী করে তাঁকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক মুসলিম। কোনও মুসলিম সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করলে সাংবাদিকের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে তাঁকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে থাকেন। সর্বশেষ নগাঁও জেলার ধিং-এ একটি ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোটা বিষয়টিকে সাম্প্রদায়িক রং চড়াতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন মুখ্যমন্ত্রী শর্মা।
ধিং-এর ঘটনায় যেহেতু তিন মুসলিম যুবকের নাম জড়িয়েছে, তাই ওই ঘটনাকে সামনে এনে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে কুৎসিত আক্রমণ শুরু করেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর আমলে নারী সুরক্ষা তলানিতে ঠেকেছে, তথ্য দিয়ে এই অভিযোগ যখন তুলতে শুরু করে বিভিন্ন মহল, তখনই তিনি মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়ানোর কৌশল গ্রহণ করেন।
রাজ্যের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে ১৮টি বিরোধী দলের এক্যমঞ্চ গুয়াহাটিতে এক জরুরি বৈঠকে মিলিত হয়েছিল। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের কাছে সিদ্ধান্তের কথা জানাতে গিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ভুপেন বরা জানান, বিধানসভার ভিতরে ও বাইরে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে দাঙ্গা বাঁধানোর চক্রান্ত রুখতে মুখ্যমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দিশপুর থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। হিমন্ত বিশ্বশর্মা মুখ্যমন্ত্রী থাকলে অসম অখণ্ড থাকবে না। তাই শর্মাকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরাতে রাজ্যপাল ও রাষ্ট্রপতির কাছ দরবার করবে বিরোধী ঐক্যমঞ্চ। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে দাঙ্গার বিষবাষ্প ছড়ানোর বিরুদ্ধে রাজ্যে শান্তি ও সৌহার্দ্যের পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রাখতে আহ্বান জানিয়েছে ঐক্যমঞ্চ।