• facebook
  • twitter
Monday, 23 December, 2024

হেমা কমিটির রিপোর্ট: পর্দা উদ্ঘাটিত হল এক অন্ধকার অধ্যায়ের

গেল বিবাহ-পূর্ব জীবনের কথা, বিবাহ-পরবর্তী জীবন আরও অনেক বেশি সঙ্কটপূর্ণ। অনেক বেশি নির্মম ও অযৌক্তিক প্রত্যাশায় ঠাসা। যেমন, বধূর কাছে পরিবারের কাম্য, সে যেন পুত্রসন্তানের জন্ম দেয়।

শোভনলাল চক্রবর্তী

কর্মক্ষেত্র মেয়েদের আর্থিক স্বনির্ভরতার সন্ধান দিতে পারে, কিন্তু তার নিরাপত্তা, সম্মান, সমানাধিকার সুনিশ্চিত করতে পারে কি? মালয়ালাম চলচ্চিত্র জগতে পর্দা উদ্ঘাটিত হল এক অন্ধকার অধ্যায়ের। জানা গেল, সে জগৎটি মেয়েদের প্রতি চরম বঞ্চনা, যৌন হেনস্থা, এবং কু-ব্যবহারের অসংখ্য ঘটনার ভারে ভারাক্রান্ত। চলচ্চিত্র জগতে ‘কাস্টিং কাউচ’ শব্দটি অপরিচিত নয়। হেমা কমিটির সাম্প্রতিক রিপোর্ট মালয়ালাম চলচ্চিত্র জগতের পরিপ্রেক্ষিতে সেই অভিযোগকেই মান্যতা দিয়েছে।

অতঃপর হেনস্থার বিরুদ্ধে একযোগে অভিনেত্রীদের মুখ খুলতে এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা প্রকাশ্যে আনতে দেখা গিয়েছে। মালয়ালি পরিচালক রঞ্জিৎ বালকৃষ্ণনের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ এনেছেন এক অভিনেত্রী। প্রাথমিকভাবে অভিযোগ অস্বীকার করলেও এর অব্যবহিত পরেই কেরলের চলচ্চিত্র অ্যাকাডেমি থেকে পদত্যাগ করেছেন পরিচালক। অ্যাকাডেমির সহ-সম্পাদক অভিনেতা সিদ্দিক, ‘অ্যাসোসিয়েশন অব মালয়ালম মুভি আর্টিস্টস’-এর সভাপতি অভিনেতা মোহনলাল পদত্যাগ করেছেন। তাঁর সঙ্গে কার্যনির্বাহী কমিটির সকল সদস্যও পদত্যাগের পথে হেঁটেছেন। এ যেন ২০১৮ সালের শেষের দিকে ভারতে শুরু হওয়া ‘মি টু’ আন্দোলনের দ্বিতীয় ঢেউ। যে আন্দোলন শুধুমাত্র দক্ষিণী বিনোদন জগতের গণ্ডি পার করে আক্ষরিক অর্থেই সর্বভারতীয় হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে। শোনা গিয়েছে, মহারাষ্ট্র সরকারও এমনই একটি কমিটি গড়ার পথে হাঁটতে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও আবেদন জানানো হয়েছে, বিনোদন জগতের সঙ্গে যুক্ত মেয়েরা যাতে সুরক্ষিত থাকেন, সুষ্ঠু বিচার পান, সেই ব্যবস্থা করার।সম্প্রতি বাংলার এক পরিচিত পরিচালকের বিরুদ্ধে যৌণ হেনস্থার অভিযোগে, তাঁকে সাসপেন্ড করেছে পরিচালক সংস্থা। কিন্তু প্রশ্ন বাস্তবচিত্র তাতে পাল্টাবে কি?
কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা আটকানোর জন্য আইন চালু হয়েছে ২০১৩ সালে। এক দশকের অধিক সময়কাল পেরিয়েও মেয়েদের যৌন হয়রানি, যৌন হয়রানিকে কাজ পাওয়ার, এবং উন্নতির শর্ত বানিয়ে তোলার মতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ হ্রাস পায়নি। ২০১৭-১৮ সাল নাগাদ যখন সমগ্র বিশ্বে ‘মি টু’ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে, তখন ভারতেও মূলত সমাজমাধ্যমকে হাতিয়ার করে মেয়েরা অভিনয় জগতে, কর্মক্ষেত্রে নিজেদের হেনস্থা হওয়ার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছিলেন। অভিযোগ উঠেছিল বলিউডের একাধিক প্রভাবশালী অভিনেতা-পরিচালকের বিরুদ্ধেও। হেমা কমিটির রিপোর্ট প্রমাণ করল, চিত্রটি অ-পরিবর্তিত।পরিবর্তনের জন্য সর্বাগ্রে জরুরি মেয়েদের অভিযোগকে গুরুত্ব দিতে শেখা। এ দেশে হামেশাই ক্ষমতা, প্রভাব এবং অর্থের বিনিময়ে হেনস্থার অভিযোগ ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়। প্রবল পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা বুঝিয়ে দেয়, যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার মূল কারণ মেয়েটির আচরণ। ভাবতে শেখায়, এর পিছনে মেয়েটিরও সম্মতি আছে। এই মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। একই সঙ্গে জরুরি কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি রোধের আইনটির সার্থক প্রয়োগ। দল, ক্ষমতা, আর্থিক-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে। কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষিত পরিবেশে সসম্মানে কাজ করা মেয়েদের ন্যায্য অধিকার। এর অনুপস্থিতি বহু মেয়েকে কর্মক্ষেত্রের পরিধির বাইরে থাকতে বাধ্য করবে। মেয়েরা যে ক্রমশ সেই বিপদ বুঝতে পারছেন এবং প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন— এইটুকুই আশার কথা।

আজ পর্যন্ত নারী যতখানি স্বাধিকার অর্জন করেছে, নারীর সুরক্ষা ও ন্যায়াধিকারের পক্ষে যত আইন তৈরি হয়েছে, তা কোনও জাদু নয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ের লড়াইয়ের ফল হিসেবে সেগুলি অর্জিত হয়েছে। ভারতে নারীর জন্য সেই লড়াই শুরু করেছিলেন পুরুষরা। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি যখন স্ট্যান্টন ভাবছেন, ‘একই স্রষ্টা নারী ও পুরুষ গড়েছেন, তা হলে কেন নারীর জীবন পুরুষের চেয়ে এত আলাদা, কেন নারীর চার দিকে শুধু নিষেধ…’ সেই সময় ব্রিটিশশাসিত ভারতে রামমোহন রায় ভেবেছেন সতীদাহ বন্ধ হোক, তাঁর কিছু বছর পর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভাবছেন, মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার কথা, ভাবছেন বাল্যবিবাহ রোধ ও বিধবাবিবাহ প্রচলনের কথা।ভারতে নারীর নারকীয় জীবনের অবসান ঘটিয়েছেন সংগ্রামী দূরদ্রষ্টা পুরুষ। সেই দূরদর্শিতা ও নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, সমানুভূতি যদি ভারতীয় ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার হতে পারত, আজকের ভারত হয়ে উঠত মহত্তর। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আজকের পুরুষ হারাতে বসেছে নারীর বিশ্বাস ও আস্থা। অথচ দুই পক্ষ মিলেই সমাজ, দুই পক্ষ মিলেই সভ্যতা। এমনকি স্বাধীন ভারতে নারীর রাজনৈতিক অধিকার একেবারে সংবিধান রচনার কাল থেকে নিশ্চিত হয়েছে।

ইউরোপ-আমেরিকার মতো ভোটাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নারীকে প্রাণ দিতে হয়নি। কিন্তু একই ভাবে, পুরুষতান্ত্রিকতা কবলিত ভারতীয় সমাজ যে ভাবে নারীর প্রতি রক্ষণশীল, সে ভাবেই এ দেশে নারীর রাজনৈতিক অধিকার দীর্ঘকাল সীমাবদ্ধ ছিল ভোটদানের অধিকারে। বহু সংগ্রামের পরেও, বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনে নারী-পুরুষের সমসংখ্যক প্রতিনিধিত্ব বলবৎ হয়নি।অর্থাৎ, নারীর প্রতি পুরুষের মানসিকতা বিগত তিন শতক যাবৎ কখনও উদার ও ন্যায়বোধসম্পন্ন, কখনও তা সঙ্কীর্ণ ও শোষণবাদী। আজও অধিকাংশ পুরুষের চোখে নারীমাত্রেই পুরুষের অধিকৃত। নারীমাত্রেই যৌনতার উপকরণ। নারীমাত্রেই দুর্বল ও সহজলভ্য। পৃথিবীর সর্বত্র কমবেশি এই দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান। তাই নারী নির্যাতন, যৌন নিগ্রহ, গার্হস্থ হিংসার রোজনামচা প্রত্যেক দেশের সমস্যা।নারী সমাজে নিজের অবস্থান বিষয়ে সচেতন হওয়ার পর মানবেতিহাস দুই ধারায় বিভাজিত হতে বাধ্য হয়। কারণ, সভ্যতার ইতিহাসে নারী ও পুরুষের পথ চলা একই প্রক্রিয়ায় হয়নি।

নৃতাত্ত্বিক মতে, আদিম জনগোষ্ঠী ছিল মাতৃতান্ত্রিক। কিন্তু সম্পদের উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজ সন্তানের নিশ্চয়তা নির্ণয়ের প্রবণতা নারীকে বন্দি করে। অর্থাৎ, এক অর্থে সম্পদ সঞ্চয় নারীর বন্দিত্বের অন্যতম কারণ। মানবসভ্যতার আদি ইতিহাসে পুরুষ নারীকে পালিত পশুর মতো ব্যবহার করেছে। সেই জায়গা থেকে আজকের নারী যতখানি সামাজিক অধিকার আদায় করেছে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেছে, তা কোনও ভাবেই যথেষ্ট বলা চলে না সামগ্রিক ভাবে সমাজমানসের জন্য।স্ট্যান্টন বলেছিলেন, নারীর অধিকার আদায়ের লক্ষ্য প্রকৃতপক্ষে এক সচল সংগ্রাম। তাঁর দূরদর্শিতা বিস্ময়কর। আমাদের দেশে আজও লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে সংগ্রাম চলেছে, চলেছে নারী ও পুরুষকর্মীর সমান পারিশ্রমিকের দাবি, শিশুকন্যার স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অধিকারের দাবি, কন্যাভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধে প্রচার।আইনত এ দেশে উল্লিখিত বিষয়গুলি সমতা প্রাপ্ত। কিন্তু আইন থাকা মানেই সমাজমানসের পরিবর্তন নয়।

বিবাহে পণ নেওয়া আইনত অপরাধ, কিন্তু এই প্রথা বন্ধ করতে পারা যায়নি। এ দেশে নানা ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের বাস। এক-এক সমাজ এক-এক নিয়মে চলে। আজও পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোয় মেয়েরা বহু ক্ষেত্রে প্রাচীন রীতিনীতি মেনে চলতে বাধ্য হয়। এই ব্যবস্থার ভিতর সব সময়ই ন্যায়-অন্যায়ের সংঘাত পরিবারে নারী বনাম পুরুষ এমন নয়, পিতৃতান্ত্রিকতার মধ্যে নিহিত স্বৈরাচার নারীকেও গ্রাস করে এবং পরিবারের প্রধান হিসেবে নারীও নারীর প্রতি অত্যাচারী হয়ে উঠতে পারেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যা ঘটে তা হল গার্হস্থ হিংসা। মেয়েকে অল্প বয়সে বিবাহ করতে বাধ্য করা, নিজের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের অধিকার কেড়ে নেওয়া, জাত, ধর্ম, বা প্রচলিত নিয়ম মানতে বাধ্য করা, আরও কত। গেল বিবাহ-পূর্ব জীবনের কথা, বিবাহ-পরবর্তী জীবন আরও অনেক বেশি সঙ্কটপূর্ণ। অনেক বেশি নির্মম ও অযৌক্তিক প্রত্যাশায় ঠাসা। যেমন, বধূর কাছে পরিবারের কাম্য, সে যেন পুত্রসন্তানের জন্ম দেয়। বহু পরিবারে এই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ না হলে বধূকে অত্যাচারিত হতে হয়।এক সুস্থ সুন্দর জীবনের জন্য শিক্ষা, তার দ্বারা জীবিকা অর্জন এবং স্বাবলম্বন হলেই কিন্তু নারীর সামাজিক সমস্যা সম্পূর্ণ দূর হয় না।

আমেরিকান নারীবাদী লেখক ও কর্মী বেটি ফ্রিডান ১৯৬৩ সালে একটি বই লেখেন। ‘দ্য ফেমিনিন মিস্টিক’ নামের বইটিতে ফ্রিডান দেখিয়েছিলেন, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিতে মেয়েদের সমস্যাগুলি কী। পশ্চিমি সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে সেই সময় যা যা উল্লেখ্য ছিল, বর্তমানে ভারতীয় শিক্ষিত নিম্ন, মধ্য, উচ্চবিত্তের সমাজে তার অধিকাংশই বিরাজমান। পশ্চিমে মধ্যবয়সে পৌঁছে বিবাহবিচ্ছেদের সমস্যা খুবই বেশি। এ দেশে বিবাহ এখনও সারা জীবনের বন্ধন মনে করা হয়। বিশেষ কোনও সমস্যা না থাকলে বৈবাহিক প্রতিষ্ঠান ও পারিবারিকতা বজায় রাখতে চান নারী-পুরুষ উভয়েই। এ ক্ষেত্রে, ‘দ্য ফেমিনিন মিস্টিক’-এর সঙ্গে বর্তমান ভারতীয় নারীর তুল্য বিষয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার প্রতিপালনের জন্য মেয়েরা স্বোপার্জিত জীবিকা ত্যাগ করেন, স্বামী তাঁর অর্জিত স্থান বজায় রাখেন। সন্তান লালনপালন ও পরিবারের দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেন নারী। যখন তাঁর সেই ফেলে আসা দক্ষতা ও পেশা পুনরর্জন করার সময় পান, তখন সেই সুযোগ আর থাকে না। বয়স অন্তরায় হয়। দীর্ঘ অনভিজ্ঞতা পরিচয়পত্রে ছায়া ফেলে।

ভারতের মতো জনবহুল দেশে চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তির পক্ষে নতুন করে জীবিকা সন্ধান খুবই কঠিন। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারে উদ্বৃত্ত অর্থ এমন পরিমাণে থাকে না যা দিয়ে স্বাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করা যায়। জীবনের এই পর্বে পরিবারকেন্দ্রিক নারীর মধ্যে জন্ম নেয় হতাশা ও একাকিত্ববোধ। নিজেকে তাঁরা অপ্রয়োজনীয় ভাবতে থাকেন। অর্থাৎ পারিবারিকতার প্রধান বলি হয়ে ওঠেন নারী, আজও।