• facebook
  • twitter
Sunday, 26 January, 2025

তারিখ পে তারিখের খপ্পরে ডিএ মামলা

বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সঠিকভাবেই বলতেন, ‘যে সরকার কর্মীদের ডিএ দিতে পারে না, তার ক্ষমতায় থাকার কোনও অধিকার নেই।’

ফাইল চিত্র।

কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের গৃহীত নীতি ও কর্মসূচির ফলে এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা ও বহুক্ষেত্রে কর্পোরেট স্বার্থে স্বেচ্ছা ব্যর্থতার কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঘটে, টাকার দাম কমে, অর্থনীতির ভাষায় মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। ফলে শ্রমিক, কর্মচারীদের প্রকৃত মজুরি, বেতনের অবক্ষয় ঘটে, প্রকৃত মজুরি বা বেতন কমে যায়। এই অবক্ষয়িত মজুরি/বেতন অবক্ষয়পূর্ব অবস্থাতে ফিরিয়ে দিতে চলতি মুদ্রাস্ফীতির হারে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। এই ক্ষতিপূরণই মহার্ঘভাতা বা ডিএ। তাই ডিএ’র কোনও কেন্দ্রীয়/রাজ্যের হার হয় না। সারা ভারতে মুদ্রাস্ফীতি পরিমাপে একটিই সর্বজনগ্রাহ্য সূচক আছে যার নাম All India Consumer Price Index (A.I.C.P.I.) বা সর্বভারতীয় দ্রব্যমূল্যসূচক। কেন্দ্র ও হাতে গোনা দু-একটি রাজ্য বাদে সব রাজ্য সরকার এই এ.আই.সি.পি.আই মেনে বছরে দু’বার ডিএ দেন, ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও দিল্লিতে কর্মরত পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারি কর্মীদের এআইসিপিআই অনুসারেই ডিএ দেন। কেন্দ্র ও পশ্চিমবঙ্গ সহ সমস্ত রাজ্য বেতন কমিশন এআইসিপিআই’কে ভিত্তি করে বেতন সংশোধন করেন। আইনি যুক্তিতেই এই এআইসিপিআই’কে অস্বীকার করার অধিকার কেন্দ্র বা কোনও রাজ্য সরকারের নেই। তাই যে কোনও ‘আত্মমর্যাদাসম্পন্ন’ সরকার মুদ্রাস্ফীতিজনিত ডিএ দিতে দায়বদ্ধ। বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সঠিকভাবেই বলতেন, ‘যে সরকার কর্মীদের ডিএ দিতে পারে না, তার ক্ষমতায় থাকার কোনও অধিকার নেই।’ মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তিনিই বলছেন ডিএ অধিকার নয়।

ডিসেম্বর-২০২৪ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যকর্মীদের ৩৯ শতাংশ (কেন্দ্র ৫৩ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ১৪ শতাংশ) ডিএ বকেয়া। জানুয়ারি-২০২৫ থেকে কেন্দ্র ও পশ্চিমবঙ্গ বাদে অন্য রাজ্যকর্মীরা অতিরিক্ত কমবেশি ৪ শতাংশ ডিএ পেতে চলেছেন। অর্থাৎ জানুয়ারি-২০২৫-এ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কর্মীরা ৪৩ শতাংশ ডিএ-তে পিছিয়ে, সৌজন্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২ অর্থবর্ষ পর্যন্ত রাজ্য কর্মীদের বেতন ও ভাতা খাতে বাজেট বরাদ্দের ২৫,২৬২ কোটি টাকা এবং সংশ্লিষ্ট খাতে কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের বরাদ্দ অর্থের ৯,০০০ কোটি টাকা, সর্বমোট ৩৪,২৬২ অব্যয়িত অবস্থায় রাজ্য কোষাগারে পড়ে আছে, যে অর্থে এক বছর ৪৪ শতাংশ ডিএ দেওয়াই যা, বকেয়া ৪৩ শতাংশ, মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। জুন-২০১১ থেকে জুলাই-২০২৪ পর্যন্ত রাজ্যকর্মীদের এআইসিপিআই অনুসারে ডিএ না দেওয়ায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২,১৯,১০৭.২৫ কোটি টাকা সাশ্রয়করেছেন, যা সর্ব অর্থে রাজ্য কর্মীদের বেতনের অংশ, সরকার কর্মীদের দেননি। সরকারের নেতা, মন্ত্রী এবং তথাকথিত ষষ্ঠ রাজ্য বেতন কমিশনের (তথাকথিত বললাম এই কারণে যে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ছাড়া অন্য কেউ এখনও এই রিপোর্ট দেখেননি, একাধিক আর.টি.আই করেও এই রিপোর্ট পাওয়া যায়নি, তাই এই রিপোর্টের বাস্তব অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট সন্দিহান) চেয়ারম্যান ড. অভিরূপ সরকার বলছেন, এই টাকায় সরকার ‘রাজ্যের উন্নয়ন’ (যে ‘উন্নয়ন’ খড়্গ হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে?) করেছেন। রাজ্যকর্মীদের ডি.এ.-র টাকায় উন্নয়ন হলে, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী তার কৃতিত্ব নিচ্ছেন কেন? রাজ্যকর্মীদের বিনা অনুমতিতে তাদের ডিএ-র টাকা অ্ন্য খাতে কোন অধিকারে খরচ করছেন মাননীয়া? অর্থের অভাবের যুক্তিতে কর্মীদের ডিএ দিচ্ছেন না সরকার। পূর্ণমন্ত্রী, রাষ্ট্রমন্ত্রী, বিধায়কদের বেতন নজিরবিহীনভাবে বাড়িয়ে যথাক্রমে দেড় লক্ষ, ১ লক্ষ ৪৯ হাজার এবং ১ লক্ষ ২১ হাজার টাকা করেছেন মাননীয়া, সঙ্গে হরেক নামে অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা। জীবিকা সেবকরা ৯ বছর ধরে বেতন পাচ্ছেন না, পঞ্চায়েতের কর সংগ্রাহকদের বেতন ৬০০ টাকা, মিড-ডে মিল কর্মীদের ১৬৬৬ টাকা, স্থায়ীপদে লক্ষ-লক্ষ শূন্যপদে নতুন নিয়োগ না করে যে বিপুল সংখ্যায় অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ করে তাদের যৎসামান্য বেতনে সরকারি কাজ করিয়ে নিচ্ছেন সরকার, স্থায়ী কর্মীদের ৪৩ শতংশ বেতন থেকে বঞ্চিত করছেন সরকার। রাজ্যের উন্নয়নের বৃহত্তর স্বার্থে নিম্নবেতনভূক স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মীরা ত্যাগ স্বীকার করবেন আর মন্ত্রী-বিধায়করা বেতন ও ভাতার নামে রাজকোষ লুঠ করবেন, এটাই ‘মা-মাটি-মানুষের সরকার?’

আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি পূরণই ট্রেড ইউনিয়নের লক্ষ্য। তাহলে মামলা কেন?২০২৩ সালে ব্রিটিশ শাসনে পুলিশকর্মীদের ইউনিয়ন/অ্যাসোসিয়েশন করার অধিকার অর্জিত হয়। ২০১২ সালের ১০ জানুয়ারি পুলিশকর্মীদের ইউনিয়ন/অ্যাসোসিয়েশন করা নিষিদ্ধ হল। স্পষ্ট হল, কর্মীদের গণতান্ত্রিক ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের প্রশ্নে তৃণমূল সরকার ব্রিটিশদের থেকেও খারাপ ও কর্মীবিদ্বেষী। তারপর একে একে অনেক দপ্তরে ইউনিয়ন/অ্যাসোসিয়েশন নিষিদ্ধ ঘোষিত হল। ২০১২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি একটি সংগঠন আজও কর্মী ধর্মঘট ভাঙতে চাকরিচ্ছেদ সহ ভয়ঙ্কর শাস্তির ফতোয়া সহ সরকারি আদেশনামা প্রকাশিত হল, ধর্মঘট ভাঙতে নজিরবিহীন ভয়ঙ্করতা প্রদর্শন করলেন সরকার ও সরকারপন্থী কর্মী সংগঠন। নবান্ন সহ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবনে প্রশাসনিক আদেশ বলে বিক্ষোভ, মিছিল, সমাবেশ, পোস্টারিং সহ সমস্ত সাংগঠনিক প্রক্রিয়া নিষিদ্ধ হল। ২০১২ সালের ১৩ই এপ্রিল আন্দোলন করার অপরাধে(?) খোদ মুখ্যমন্ত্রীর অফিসে কলম ও আমাদের সংগটনের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মলয় মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ৩ জন মহিলা অফিসারের শ্লীলতাহানি সহ প্রকাশ অযোগ্য কুৎসিত কল্পিত অভিযোগে জামিন অযোগ্য ধারায় এফআইআর করলেন। সরকার কর্মী-নেতাদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে এফআইআর করে ফাঁসিয়ে দিচ্ছেন— এমন নজির বিরল। ২০১৪ সালে চাকুরিবিধিতে সংশোধন এনে ৬ মাসের জন্য সচিবালয় কর্মী/আধিকাকিদের অসচিবালয় দপ্তরে বদলির (ডিটেলমেন্ট) অধিকার হাতে নিলেন সরকার। সরকারের ব’কলমে সরকারপন্থী কর্মী সংগঠন সচিবালয়ের কর্মী/আধিকাকিদের ‘সবক’ শেখাতে সুনামির কায়দায় ডিটেলমেন্টের চূড়ান্ত প্রতিহিংসামূলক অপব্যবহার করে চলেছেন। একবার যে এই ৬ মাস মেয়াদি ডিটেলমেন্টের খপ্পরে পড়েছেন, তাকে অবসরগ্রহণ/মৃত্যু পর্যন্ত প্রত্যন্ত এলাকার ব্লক অফিসেই থেকে যেতে হয়। একই কায়দায় অসচিবালয় কর্মীদেরও ব্যাপকহারে প্রতিহিংসামূলক বদলির শিকার হতে হয় ‘স্রেফ ‘আমাদের লোক’ না হতে পারার অপরাধে(?)। শো-কজ, সাসপেনশন, কম্পালসারি ওয়েটিং—প্রতিবাদী কর্মীদের সবক্ শেখানোর হাতিয়ার হয়ে ওঠে। কর্মীসংগঠনের সঙ্গে সরকারের আলাপ-আলোচনার সমস্ত পথ বন্ধ করে দেন সরকার। থানার ও.সি. থেকে ডি.জি/ কমিশনার, বিডিও থেকে মুখ্যসচিব (বিচ্ছিন্ন দু-একটা ব্যতিক্রম আছে) সরকারের ব’কলমে সরকারপন্থী কর্মী সংগঠনের ক্রীতদাসের ভূমিকায় স্বচ্ছন্দ বোধ করতে থাকেন। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এতটাই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে যে, আন্দোলনতো দূর-অস্ত, নিছক প্রতিবাদ সভায় কর্মী সমাগম হতাশাজনক হয়ে ওঠে।

সর্বত্র একটা হিমশীতল আতঙ্কের স্রোত। এই আতঙ্ক থেকে কর্মী সমাজকে বের করতে, সরকারকে বার্তা দিতে আামাদের সংগটনের পক্ষে সাধারণ সম্পাদক মলয় মুখোপাধ্যায় স্যাটে এআইসিপিআই মেনে ডিএ-র দাবিতে নিতান্ত কৌশলগত অবস্থানের জায়গা থেকেই, পিটিশন দাখিল করেন। মামলা শুরু হয় যার নাম “State of W.B. & Ors. Vs. Confederation of State Govt. Employees & Ors.” (ডিএ মামলা)। সে সময় আমাদের আইনজীবী ছিলেন সর্দার আমজাদ আলি (সে সময়ে রাজরোষের সম্মুখীন হওয়ারআতঙ্কে একাধিক সিনিয়র আইনজীবী আমাদের মামলা নেননি, একজন সিনিয়র আইনজীবী আমাদের বেশ কিছুদিন ঘুরিয়ে এই মামলায় সরকার পক্ষের আইনজীবী হিসাবে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।) সর্দার আমজাদ আলি রাজরোষ উপেক্ষা করে আমাদের মামলা নিয়েছিলেন। ২০১৬ সালে মামলা দায়ের করার সময় ৫ম রাজ্য বেতন কমিশন ও ‘রোপা-২০০৯)-এর সময়কালে ৫০ শতংশ ডিএ বকেয়া ছিল, যার পূর্বতন বাম সরকার ১৬ শতাংশ ডিএ’র সংস্থান রেখে গিয়েছিলেন বাজেটে, সে কারণে বাকি (৫০ শতাংশ-১৬ শতাংশ) ৩৪ শতাংশ বকেয়া ডিএ-র দাবিতে মামলা। এই মামলার (ও.এ. নম্বর: ১১৫৪/১৬) মূল ভিত্তি ‘রোপা-২০০৯’ যাতে এ.আই.সি.পি.আই. অনুসারে বছরে দু’বার কর্মীদের ডিএ পাওয়ার অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে গিয়েছিলেন পূর্বতন বাম সরকার। আমরা মামলা দায়ের করার আগে সরকারপন্থী নয়, এমন প্রতিটি সরকারি কর্মী সংগঠনের সঙ্গে (শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী সংগঠন স্যাটে মামলা করতে পারেন না) দীর্ঘ আলোচনার প্রক্রিয়া চালিয়েছি যাতে সরকারপন্থী নয়, এমন সব সংগঠন একসঙ্গে মামলা করা যায়। একটি ছোট কর্মীসংগঠন ছাড়া অন্য কোনওসংগঠন আমাদের প্রস্তাবে সাড়া দিতে পারেনি। স্যাটে বিচারপতি অসিত তালুকদার (চেয়ারম্যান) এবং এ কে চন্দ্রের ডিভিশন বেঞ্চ তাঁদের রায়ে বলেছিলেন, “As it is found by the Tribunal that no one can have any legal right for staking a claim for D.A., payment of the same bring remaining in the sole discretionary realm of the Employer.”

বস্তুত ঠিক এই কথাই বারবার বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর পরেরটা পুরো কর্মীপক্ষের অনুকূলে ইতিহাস। আমরা ২০১৭ সালে ১৪ মার্চ স্যাটের রায়ের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি নিশীথা মাত্রে ও বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চে মামলা করি (W.P.S.T. No. 45/2017)। সেপ্টেম্বর-২০১৭-তে এই বেঞ্চ নির্দেশ দিলেন, ’১০ দিনের মধ্যে কেন্দ্র ও রাজ্যকর্মীরা কত ডিএ পাচ্ছেন, তা হলফনামা দিয়ে রাজ্যকে জানানোর।’ বস্তুত এই বেঞ্চের চাপে মাননীয়া ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে সরকারপন্থী কর্মী সংগটনের সভায় (০১.০১.২০১৮ থেকে কার্যকর) অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ ডিএ দেওয়ার ঘোষণা করতে বাধ্য হন, সঙ্গে উপরি পাওনা সরকারি কর্মীদের কুকুর, বেড়ালের সঙ্গে তুলনা। ওই সভায় উপস্থিত সরকারি কর্মীরা কোনও প্রতিবাদ করেননি, বরং এমন সুমধুর সম্ভাষণে বেশ স্বচ্ছন্দই ছিলেন। অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত হলফনামা দিয়ে বেঞ্চকে জানালেন ১৫ শতাংশ ডিএ দেওয়ায় রাজ্যকর্মীরা ১০০ শতংশ ডিএ পেলেন। দুর্ভাগ্য, শুনানি পর্ব শেষ হওয়ার পরও নিশীথা মাত্রের ডিভিশন বেঞ্চ মামলার রায় না দিয়ে ডিসেম্বর, ২০১৭-তে নিশীথা মাত্রে অবসর নেন, কেন অবসরের আগে তিনি রায় দিয়ে গেলেন না তা আমাদের কাছে এক রহস্য। মামলা গেল বিচারপতি দেবাশিস করগুপ্ত ও শেখর ববি শরাফের ডিভিশন বেঞ্চে। রীতি অনুসারে মামলা আবার শূন্য থেকে শুরু হল। আগের বেঞ্চের দীর্ঘ শুনানি পর্বের কোনও মূল্যই রইল না, চূড়ান্ত ক্ষতিগ্রস্ত হল কর্মীপক্ষ। আদালত এবং অপসরের মুখে থাকা বিচারপতিদের ভেবে দেখা দরকার— (১) কেন অবসরের মুখে থাকা বিচারপতির এজলাসে গুরুত্বপূর্ণ মামলা দেওয়া হবে? (২) কেনই বা সংশ্লিষ্ট বিচারপতি তাঁর অবসরের আগে তাঁর এজলাসে থাকা মামলা অসমাপ্ত অবস্থায় রেখে মামলাকারীর ক্ষতি করবেন?

এই নতুন বেঞ্চও রাজ্যকে কেন্দ্র ও রাজ্যের ডিএ-র তথ্য হলফনামা দিয়ে জানাবার নির্দেশ দিলেন। রাজ্য সরকার ১৯ জুন, ২০১৮-তে ১০ শতাংশ ইন্টারিম রিলিফ তুলে দিয়ে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ ডিএ (০১.০১.২০১৯ থেকে কার্যকর) দেওয়ার ঘোষণা করলেন। এজি আদালতকে তা জানালেন। ০১.০১.২০১৯ থেকে রাজ্য কর্মীদের ডিএ হল ১২৫ শতাংশ, যা কেন্দ্র ও অন্য রাজ্যের কর্মীরা পেয়েছেন ০১.০১.২০১৬ থেকে। হাইকোর্টের এই দু’টি বেঞ্চের শুনানির সময় যাঁরা হাজির ছিলেন, তাঁরা জানেন এই দু’টি বেঞ্চের চাপেই রাজ্য সরকার যথাক্রমে ১৫শতাংশ ও ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত ডিএ (৪০ শতাংশ সর্বমোট) দিতে বাধ্য হয়েছেন। অন্যথা এই ৪০ শতাংশ ডিএ নতুন বেতন ক্রমে Notional Fixation হিসাবে খাতায়-কলমে পাওয়া যেত, বাস্তবে নয়। এই বেঞ্চ গত ৩১ আগস্ট, ২০১৮ তাদের ঐতিহাসিক রায়ে বললেন, ‘D.A. is a legally enforceable right of the Employees.” আমাদের একাধিক আদালত অবমাননার মামলা, সরকারের একাধিক রিভিউ পিটিশনের বর্ণনায় গেলাম না। গত ২০ মে, ২০২২ বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডন এবং রবীন্দ্রনাথ সামন্তের ডিভিশন বেঞ্চ তাদের ঐতিহাসিক রায়ে বললেন, “D.A. is a legally enforceable fundamental right of the Employees.” বস্তুত এই দুই রায়ের আগে এত সুনির্দিষ্টভাবে ডিএ’কে কর্মীদের অধিকার হিসাবে কোথাও আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ২০২২ সালে যে দু’টি মামলা কলকাতা হাইকোর্টের বর্ষসেরা মামলার স্বীকৃতি পায়, তার অন্যতমএই ডিএ মামলা। নিছক একটি মামলা নয়, বর্ষসেরা মামলার স্বীকৃতি পায়, তার অন্যতম এই ডিএ মামলা। নিছক একটি মামলা নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছ থেকে অধিকার ছিনিয়ে নিতে এই মামলা।

কলকাতা হাইকোর্টের সর্বশেষ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে এসএলপি দাখিল করে রাজ্য সরকার। শুনানির দিন ধার্য্য হয় ২ ডিসেম্বর, ২০২২। সরকার সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে (Mention Hearing) বলে, ৩০ নভেম্বর কলকাতা হাইকোর্টে যে াদালত অবমাননার মামলার শুনানি রয়েছে, তাতে রাজ্যের মুখ্যসচিব ও অর্থসচিবের বিরুদ্ধে রুল জারি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সুপ্রিম কোর্টে মামলার শুনানি ৩০ নভেম্বরের আগে হোক এবং সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলাকালীন হাইকোর্টে এই সংক্রান্ত মামলার শুনানি বন্ধের নির্দেশ দিন আদালত। সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যের আবেদন মঞ্জুর করে নির্দেশ দেন, শুনানির দিন ধার্য্য হয় ২৮ নভেম্বর, ২০২২। এ নিয়ে কিছু বলার নেই, কারণ এই নির্দেশ আইনসঙ্গত। কিন্তু এই সুপ্রিম নির্দেশে সরকার পক্ষ সুবিধা পায়। অন্যদিকে গত ২৮ নভেম্বর, ২০২২ থেকে ৭ জানুয়ারি, ২০২৫ পর্যন্ত ২ বছর ১ মাস ৭ দিন ১৪টি শুনানির পরেও মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য কর্মীপক্ষের আবেদনে সেই সুপ্রিম কোর্ট এখনও সাড়া দেননি। রাজ্য সরকার জানেন, এই মামলার কর্মীপক্ষের জয় নিশ্চিত। তাই সরকারপক্ষ চাইছেন, মামলা যতটা সম্ভব দীর্ঘায়িত করতে যাতে কর্মীসমাজে আদালত সম্পর্কে হতাশা তৈরি হয়, হতাশাগ্রস্ত কর্মী সমাজ থেকে আর্থিক রসদ সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে কর্মীপক্ষ রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হয়। সুপ্রিম কোর্টেরই ‘তারিখ-পে-তারিখ’ সংস্কৃতিতে রাজ্য সরকারের সুবিধা ও মামলাকারী কর্মী সংগঠনের সংকট বাড়ছে। প্রচার হচ্ছে সরকার পক্ষের আইনীবী অভিষেক মনু সিংভির হাতযশে মামলা বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ইডি, সিবিআই সহ কেন্দ্রীয় এজেন্সির এ রাজ্যে তদন্তের ক্ষেত্রে রাজ্যের ‘কনসেন্ট’ ও ‘কেন্দ্রীয় এজেন্সির এক্তিয়ার’ সংক্রান্ত মামলা, এ রাজ্যে সিবিআই, ইডি’র দুর্নীতি বিরোধী তদন্তের সুনামির প্রেক্ষিতে, রাজ্য সরকার ও শাসক দলের কাছে ডিএ মামলার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ডিএ মামলায় সরকার পক্ষ একজন অভিষেক মনু সিংভিকে নিয়োগ করেছেন, ইডি, সিবিআই তদন্তের এক্তিয়ার ও রাজ্যের ‘কনসেন্ট’ সংক্রান্ত মামলায় অনেক ‘অভিষেক মনু সিংভি’কে নিয়োগ করেছে রাজ্য। মামলাটিতে তিন বছরে ২৫ বার শুধু ‘তারিখ’ মিলেছে। এমন একাধিক মামলার উল্লেখ করাই যায় যে সব মামলায় রাজ্য সরকার নিয়োজিত ‘অতি মহার্ঘ’ নামিদামি ব্যারিস্টার নিয়োগ করেও লক্ষ্য পূরণে সফল হননি। সংগঠনের পক্ষে ২৫/৩০/৪০ লাখি আইনজীবী নিয়োগের আর্থিক সামর্থ্য নেই জেনেও পরামর্শ আসছে, ‘বিকাশবাবুদের দিয়ে কিছু হবে না, ওদের সরিয়ে হরিশ সালভেকে নিয়োগ করুন।’ আমরা সুপ্রিম কোর্টে ১৪টি শুনানিতে সর্বমোট যা খরচ করেছি, শুনেছি হরিশ সালভেজির একদিনের সম্মান দক্ষিণা তার থেকেও বেশি। তা ছাড়া যে সময়ে স্যাট ও হাইকোর্টের একাধিক প্রথিতযশা আইনজীবী রাজরোষের আতঙ্কে মামলা নেননি, সে সময়ে আমাদের পূর্বতন আইনজীবী সর্দার আমজাদ আলি, বর্তমান আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, ফিরদৌস শামিমরা শুধু মামলাই নেননি, কর্মীপক্ষে ছ-ছ’টি ‘জয়’ এনে দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী রইফ রউমও যথেষ্ট দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আইনজীবী। শুনানি পর্বই শুরু হল না, আমাদের বর্তমান আইনজীবীদের সরিয়ে দেবই বা কেন? শুনানি পর্ব শুরু হলে বোঝা যাবে, সুপ্রিম শুনানিতে আমাদের আইনজীবীরা যথেষ্ট স্বচ্ছন্দ কিনা, তখন তো নতুন ভাবনাচিন্তার সুযোগ থাকছেই। রাজনৈতিক অপছন্দ থেকে কোনও আইনজীবীর পেশাগত দক্ষতা সম্পর্কে অকারণ অবমাননা সমর্থনযোগ্য নয়।

২৮ নভেম্বর ২০২২-এর আগে পর্যন্ত কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীরা ব্যক্তিগতভাবে ডিএ মামলার সঙ্গে ছিলেন, আছেন, থাকবেনও। কিন্তু সমস্ত কর্মী সংগঠন ডিএ মামলা সম্পর্কে নির্লিপ্ত অবস্থানে থেকেছেন। ২০১৬ থেকে ২৮ নভেম্বর, ২০২২ পর্যন্ত সময়ে একটি মাত্র সংগঠন এই মামলায় গত ১৩ এপ্রিল, ২০২২-এ যুক্ত হয়, রায় হয় ২০ মে, ২০২২। গত ২৮ নভেম্বর, ২০২২ সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি দীনেশ মাহেশ্বরী ও হৃষিকেশ রায়ের ডিভিশন বেঞ্চ একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘২০১৮ সালে রায়। সেই রায়কে রাজ্য চ্যালেঞ্জ করেনি। উল্টো হাইকোর্টে রিভিউ পিটিশন করে রায়কে আইনগ্রাহ্যতা দিয়ে দিয়েছে সরকার। এতদিন পরে এসএলপি কেন?’ এই পর্যবেক্ষণে স্পষ্ট হয়্ ২০১৮ সালে ‘D.A is a legally enforceable right of the Employees”— এই রায় ইতিমধ্যে ‘Legality’ পেয়েছে, তাই এ রায় অপরিবর্তিত থাকছে। শুধুমাত্র ২০২২ সালের রায় সম্পর্কে বিচার চলবে। এটি কর্মীপক্ষের জন্য নিঃসন্দেহে সুসমবাদ। কিন্তু ওদিন সরকার পক্ষ আদালতে জানায়, ‘এই মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কম4রত ও অবসরপ্রাপ্ত মিলিয়ে ৩ লক্ষ ১৯ হাজার জন, যাদের বকেয়া ডিএ দিতে রাজ্যকে ৪১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা খরচ করতে হবে, যা রাজ্যের পক্ষে অসম্ভব।’ এই বক্তব্যে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী সংগঠনগুলি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, কারণ পূর্বোক্ত ৩ লক্ষ ১৯ হাজার সংখ্যার মধ্যে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী সহ অন্যান্য কর্মীরা নেই। মামলা যেহেতু স্যাটের, তাই এই ৩ লক্ষ ১৯ হাজার সংখ্যা শুধুমাত্র সরাসরি সরকারি কর্মীদের। এরপরই শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী সংগঠনগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠেন, ২০২৩ সাল থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনে অনুঘটক এই মামলার রায়ে সম্ভাব্য উপভোক্তার তালিকা থেকে বাদ পড়ার আতঙ্ক। আমাদের সংগঠন শুধু সরকারি কর্মীদের জন্য মামলা করেনি, পিটিশনে পঞ্চম রাজ্য বেতন কমিশনে যাদের বেতন ক্রমের সুপারিশ হয়েছে এবং ‘রোপা-২০০৯’-এ যাদের বেতনক্রম নির্ধারিত হয়েছে, তাদের ডিএ’র কথাই বলা হয়েছে। সেই পিটিশনের বক্তব্য অনুসারে কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত মিলিয়ে কমবেশি ১০ লক্ষ সরকারি কর্মী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী এই মামলার আওতায়। স্যাটে এই মামলায় শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী সংগঠনগুলির যুক্ত হওয়ার সুযোগ ছিল না, স্যাট শুধুমাত্র সরকারি কর্মীদের। কিন্তু ২০১৭ সালে মামলা যখন হাইকোর্টে, তখন থেকে ১৯ মে, ২০২২ পর্যন্ত শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী সংগঠনগুলি এই মামলায় যুক্ত হতেই পারতেন। এই মামলায় যুক্ত হলে, বর্তমান অনিশ্চয়তা থেকে তাঁরা মুক্ত থাকতেই পারতেন।

ডিএ মামলার মূল ভিত্তি ‘রোপা-২০১৯’-এ প্রদত্ত এআইসিপিআই অনুসারে কর্মীদের ডিএ পাওয়ার অধিকার। ‘রোপা-২০১৯’-এ ডিএ নামক শব্দটাই নেই। অর্থাৎ ‘রাপা-২০১৯’-এর সময়কালে রাজ্য সরকার ডিএ’কে অধিকার হিসেবে মান্যতা দেননি। প্রয়োজন ছিল, ডিএ’র অধিকারকে ‘রোপা-২০০৯’-এর মতো ‘রোপা-২০১৯’-এ অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে মামলা করা। ডিএ মামলার মূল মামলাকারী সংগঠন হিসাবে ডিএ ইস্যুতে দ্বিতীয় কোনও মামলা, এই মামলা বিচারাধীন থাকাকালীন সময়ে, আইনি বাধ্যবাধকতায় আমাদের সংগঠন করতে পারে না। এই মামলা সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলে ‘রোপা-২০১৯’ নিয়ে মামলা করার সময়সীমা অতিক্রম করে যাবে, অথচ ‘রোপা-২০১৯’-এ ডিএ’কে অন্তর্ভুক্ত করতে না পারলে ‘রোপা-২০০৯’-এর সময়সীমার পর (বর্তমান ডিএ মামলা ‘রোপা-২০০৯’-এর উপর) ডিএ আর ‘অধিকার’ থাকছে না। এ কারণে আমরা বারবার বাকি সব সংগকঠনের কাছে আবেদন করেছি ‘রোপা-২০১৯’ নিয়ে মামলা করার। কোনও সাড়া পাইনি। আসলে ১০ বছর ধরে রাজরোষ উপেক্ষা করে তৈরি করা জমিতে শেষ মুহূর্তে খেলতে নেমে জয়ের কৃতিত্ব নেওয়ার আগ্রহ আছে, কিন্তু নতুন করে ইতিহাস তৈরির ঝুঁকি নেওয়ায় অনাগ্রহ প্রবল। এখন তো –টি-টোয়েন্টি’র যুগ।

২০২৫-এ মামলা দশম বছরে পা দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট একাধিকবার বলেছেন, ‘Justice delayed, justice denied.’ এ দেশের প্রধানমন্ত্রী নন্-বায়োলিজিক্যাল। সুপ্রিম কোর্টের পূর্বতন প্রধান বিচারপতি প্রকাশ্যে বলেন, ঐশ্বরিক নির্দেশে মামলার রায় দিয়েছেন। জানি না কোন ঈশ্বরের অঙ্গুলি হেলনে এখনও ডিএ মামলা শোনার সময় করে উঠতে পারেননি সেই বিচারপতিরা, যাঁরা প্রতি মাসে বেতনের সঙ্গে এআইসিপিআই মেনে ডিএ পান। তবে শুনানি যেদিনই হোক, On meit বিচারপর্ব হলে, কর্মী পক্ষের জয় নিশ্চিত। D.A. is a legally enforceable right of the Employees”— এই রায় থাকছেই।