পরাজয় ভেবে জয়

হরিয়ানার নির্বাচনে জয়ের জন্য প্রবল আত্মবিশ্বাসী ছিল জাতীয় কংগ্রেস— কিন্তু কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধির জিলিপির প্যাঁচ কাজে লাগল না এবং জয় ছিনিয়ে নিল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। কিন্তু বিজেপির বড় বড় নেতারা এবার হরিয়ানায় পরাজয়ের কথা ভাবতে ভাবতে জয় ঢুকে গেল বিজেপির ঝুলিতে। বিজেপির কাছে এবারের জয় প্রত্যাশিত ছিল না। কারণ দশ বছরের বিজেপি শাসনে রাজ্যের মানুষ অখুশি ছিলেন এবং বিজেপি সরকারের নানা ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কথাই তাদের কথায় শোনা যেত। কিন্তু কংগ্রেস বিজেপি শাসনের সেই ব্যর্থতাকে কাজে লাগাতে পারল না। এখন এই পরাজয় কংগ্রেসকে চরম হতাশাগ্রস্ত করে তুলল। অপরদিকে যেখানে পরাজয়ের কথাই বিজেপি নেতারা বেশি ভাবছিলেন, সেখানে জয় আসাতে দল উজ্জীবিত হল। এখন বিজেপি আসন্ন মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ডের নির্বাচনে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়বে। বিজেপি নেতারা এখন থেকেই বলতে শুরু করেছেন হরিয়ানার জয়ে নির্বাচনমুখী দুই রাজ্যে তাদের কর্মীরা বাড়তি প্রাণশক্তিতে ভরপুর হয়ে লড়বে। নির্বাচন শেষে বিভিন্ন সমীক্ষায় বলা হয়েছিল বিজেপি এবং হরিয়ানায় মুখ থুবড়ে পড়বে এবং কংগ্রেসের জয় নিশ্চিত। কিন্তু সমীক্ষার ফলও চূড়ান্ত ভুল প্রমাণিত হল।

কিন্তু কেন কংগ্রেসের এই পরাজয়? এই নির্বাচনে হরিয়ানার জাঠ নেতা এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র সিং হুডার ওপরে একটু বেশি নির্ভর করেছিল কংগ্রেস নেতৃত্ব। তাছাড়া কংগ্রেসের হয়ে প্রচারের ঢিলে দেওয়া হয়েছিল। কারণ কংগ্রেস নেতাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এবার বিজেপির পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু দেখা গেল এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে অবাধ ভোট পেতে মরিয়া হয়ে প্রচারে নেমেছিল বিজেপির নেতা-কর্মীরা। তার ফলে কংগ্রেসের অপ্রত্যাশিত পরাজয় এবং বিজেপির নেতাদের ভাবনার বাইরে জয়। ভোটের ফল বের হওয়ার পর কংগ্রেস যে পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করেছে, তাতে দেখা গেছে কংগ্রেস প্রচারকারীদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল। হরিয়ানার কংগ্রেসের অভিজ্ঞ নেতারাও প্রচারে সেভাবে নামেননি। একমাত্র রাহুল গান্ধি প্রচারের মূল দায়িত্বে থেকে প্রচার চালিয়েছেন। বিজেপির অপশাসনের বিভিন্ন দিক সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে তুলে ধরার যে প্রয়োজন ছিল— কিন্তু কার্যত দেখা গেল তা করা হয়নি। ফলে ফল বের হলে দেখা গেল, যে আসনগুলিতে কংগ্রেসের জেতার কথা, সেখানে বিজেপি প্রার্থীরা জিতে গেলেন।

কংগ্রেস ধরেই নিয়েছিল এবার হরিয়ানায় তাদের জয় নিয়ে কোনও অনিশ্চয়তা নেই। তাই প্রচারে ঢিলে দেওয়া হয়েছিল। কংগ্রেস কর্মীরা সেভাবে মনপ্রাণ ঢেলে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করে বিজেপির অপশাসনের কথা মানুষের সামনে তুলে ধরেনি। বিজেপি কংগ্রেসের প্রচারে ঢিলে দেওয়ার সুযোগটা ভালো করেই নিয়েছে। এবং যেসব আসনে নিশ্চিত পরাজয় বলে ধরা হয়েছিল, সে সব আসনে বিজেপি প্রার্থীরা জিতে গেছে। সুতরাং কংগ্রেসের পরাজয়ের কারণ হিসেবে তিনটি বিষয় উঠে আসছে। প্রথমত এবং প্রধানত হুডা পরিবারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, দ্বিতীয় প্রচারে বিরাট গাফিলতি এবং স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে যে কোন্দল তা মেটানোর কোনও চেষ্টা। রাহুল গান্ধি এই নেতাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে প্রচারে নামার শুধু নির্দেশই দিয়েছিলেন। তাতে কোন্দল মেটেনি।


বিজেপির জয়ে বিজেপি নেতারাও বিস্মিত। কারণ দশ বছর ক্ষমতায় আসীন থেকে প্রশাসনিক স্তরে নানা ভুলভ্রান্তি হয়েছে। সুতরাং বিজেপি সরকারের ওপর মানুষের ক্রোধ বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেস সেই ভুলভ্রান্তি মানুষের কাছে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। বিজেপি হরিয়ানায় জিতে এখন মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ডে জেতারও স্বপ্ন দেখছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের কথা?, কংগ্রেস যেভাবে চলছে, তার সংশোধন না হলে, হরিয়ানার মতো ফল অন্য নির্বাচনমুখী রাজ্যেও পড়বে। পরন্তু, কংগ্রেসের এই পরাজয় বিজেপি বিরোধী জোটের ওপরও প্রভাব ফেলেছে। হরিয়ানায় বিজেপিও খুব বেশি একটা জোর দেয়নি প্রচারে কারণ বিজেপি নেতৃত্ব এবারের নির্বাচনে জয়লাভ করবে, তা ভাবতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী হরিয়ানায় নির্বাচনী প্রচারে এসে মাত্র চারটি সভা করেছেন। এই সভাগুলিতে লোক সমাগম তেমন দেখা যায়নি।

হরিয়ানায় এবার কংগ্রেস সরকার গড়বে ধরে নিয়ে পুরো কৃতিত্বই রাহুল গান্ধিকে দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ফল হল উল্টো। কংগ্রেস ভেবেছিল গত দশ বছরে বিজেপি সরকার রাজ্যের উন্নয়নের জন্য উল্লেখযোগ্য এমন কিছু করেনি, যার জন্য ভোট মানুষের সমর্থন পেতে পারে। পক্ষান্তরে কংগ্রেসের প্রচারের মূল বিষয় ছিল গত দশ বছরে বিজেপির অপশাসনকে মানুষের কাছে তুলে ধরে, বিজেপির পরাজয় ঘটানো এবং হুডাকে মুখ্যমন্ত্রী করা।

রাজনীতিতে অনেক কিছুই ঘটে, যা সম্ভব নয় বলে বিবেচিত হয়, তা শেষ পর্যন্ত অসম্ভব হয়ে যায়। বিজেপির দুই দশক শাসনে বেকারের সংখ্যা আরও বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রচারে বেকারিত্ব দূর করার কথা বললেও, সাধারণ মানুষ তা বিশ্বাস করেনি। বিজেপি সরকার এ ব্যাপারে কিছুই করেনি।