প্রবীর মজুমদার
রাত পোহালেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। বিশ্বজুড়ে একটাই প্রশ্ন- আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কে হবেন তা নিয়ে- কমলা হ্যারিস, নাকি ডোনাল্ড ট্রাম্প? ডেমোক্র্যাট না রিপাবলিকান? আমেরিকার ভোটারদের মতোই এ-নির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকিয়ে আছেন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, নাকি প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পই আবার নির্বাচিত হন, সেটিই দেখার অপেক্ষায় তাঁরা। সর্বশেষ ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গা বাধিয়েছিলেন ট্রাম্প।
একটা দেশের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন নিয়ে গোটা বিশ্বের এই কৌতূহল একটু হাস্যকর। প্রেসিডেন্ট পরিবর্তনে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, সমাজনীতিতে কী পরিবর্তন ঘটবে, তা নিয়ে আমেরিকার বাইরের জনগণের চিন্তার কারণ আছে কি? আমেরিকার বাইরের জনগণের উদ্বেগের কারণ হল ইতিহাস বলে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যে দলেরই হোন না কেন, সে দেশের বিদেশনীতিতে বিশেষ কোনও পরিবর্তন হয় না। বিশ্বে মোড়লগিরিতে শীর্ষ অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাতব্বরিতে মার্কিন প্রশাসন কার ওপর কতোটা ছড়ি ঘোরাবে, তা অনেকটা এ নীতির ওপর নির্ভরশীল। আর তাই নির্বাচন-পরবর্তী মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি কী হতে পারে, তা নিয়ে আগ্রহ রয়েছে মানুষের।
এবারের নির্বাচনে যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে সকল পূর্বাভাসেই তা বলা হচ্ছে। কে জিতবেন, কে হারবেন তা অনিশ্চিত। চলতি বছরের শুরুতে বিভিন্ন জরিপে ডোনাল্ড ট্রাম্প এগিয়ে থাকলেও, শেষ দিকে এসে জনসমর্থনের কাঁটা উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করে। সামান্য ব্যবধানে হলেও ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে যান কমলা হ্যারিস।
তথাকথিত প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির শাসনকালেই ইজরায়েল প্যালেস্টাইনে, লেবাননে যথেচ্ছ বোমাবর্ষণ করে হাজার হাজার শিশু, নারী, পুরুষ হত্যা করছে। আমেরিকার কাছ থেকে বোমা নিয়েই। ডেমোক্র্যাট কমলা হ্যারিসকে হারিয়ে দক্ষিণপন্থী রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা দখল করলেও প্যালেস্তাইন, লেবাননে ইজরায়েলের সন্ত্রাসবাদী গণহত্যা বন্ধ হবে না। মার্কিন রাজনীতিতে যে দুটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল একে-অপরের মতাদর্শগত প্রতিপক্ষ, যুদ্ধ ও শান্তির প্রশ্নে তারা সহমত। আসলে আমেরিকার “গণতন্ত্র” হল একটি মধুর বিভ্রম যার মাধ্যমে ধনকুবের নিয়ন্ত্রকরা সরল মানুষদের বোঝায় যে পার্টি-১ থেকে পার্টি-২ আলাদা৷ আবার প্রয়োজনমতো সেটা বদলে যায়। আমেরিকার শাসক ও বিরোধী দুই দলই ইজরায়েলের নৃশংসতার প্রতিটি অনৈতিক পদক্ষেপকে সমর্থন করেছে যা ৪৩,০০০-এরও বেশি প্যালেস্তাইনি শিশু এবং মহিলাদের হত্যা করেছে, কার্পেট বোমা হামলা, ইচ্ছাকৃত অনাহার, চিকিৎসা-সেবা অস্বীকার, রোগের বিস্তার, জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে চলেছে প্রতিদিন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত শতাব্দীতে ডেমোক্রাটিক এবং রিপাবলিকান উভয় প্রশাসনের অধীনে অসংখ্য সংঘর্ষে জড়িত ছিল, কিছু যুদ্ধ প্রত্যক্ষ, বৃহৎ মাপের এবং অন্যগুলি পরোক্ষ সমর্থন বা সামরিক অভিযানের সঙ্গে জড়িত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রাথমিক পর্যায়ে নিরপেক্ষ থাকলেও পরবর্তী সময়ে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ডেমোক্রাট প্রেসিডেন্ট উইলসনের নেতৃত্বে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় ছিল ডেমোক্রাটরা। প্রথমে ডেমোক্রাট প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট পার্ল হারবারে হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্ত করেন। পরে ডেমোক্রাট প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানের অধীনে যুদ্ধ শেষ হয় জাপানের উপর পারমাণবিক বোমা ফেলে। ১৯৫০-১৯৫৩ সালের কোরিয়া যুদ্ধ হ্যারি এস ট্রুম্যানের অধীনে শুরু হয় চিন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত উত্তর কোরিয়ার বাহিনির বিরুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়ার সমর্থনে। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ার প্রশাসনের অধীনে সংঘাত শেষ হয়েছিল। আবার প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের সময়কালেই ১৯৫৫ সালে ভিয়েতনামে যুদ্ধে নেমে পড়েছিল আমেরিকা। ডেমোক্রাট প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ভিয়েতনাম যুদ্ধকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসারিত করেছিলেন এবং ডেমোক্রাট প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন এটিকে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে পরিণত করেছিলেন। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের অধীনে ১৯৭৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের সঙ্গে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। ১৯৯৯ সালে ডেমোক্রাট প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন কসোভোতে জাতিগত নিধন বন্ধ করতে যুগোস্লাভিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটো বোমা হামলার নেতৃত্ব দেন। এটি একটি সীমিত পদক্ষেপ ছিল যার মধ্যে বিমানশক্তি এবং ন্যাটোবাহিনির সীমিত স্থল-অভিযান যুক্ত ছিল। ডেমোক্রাট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পাকিস্তান, ইয়েমেন এবং সোমালিয়ার মতো দেশে ড্রোন হামলা চালু রেখে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ অব্যাহত এবং প্রসারিত করেছেন। মুয়াম্মার গাদ্দাফির শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী বাহিনিকে সমর্থন করার জন্য ওবামা ২০১১ সালে লিবিয়ায় হস্তক্ষেপের নেতৃত্ব দেন। ২০১১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ না হলেও, ওবামা প্রাথমিকভাবে সীমিত বিমান হামলার মাধ্যমে এবং আইএসআইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কুর্দি-নেতৃত্বাধীন বাহিনিকে সমর্থন করার মাধ্যমে বাশার আল-আসাদের সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সমর্থন শুরু করেছিলেন।
রিপাবলিকানদের যুদ্ধের ইতিহাস বড় কম নয়। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ার কোরিয়ায় সক্রিয় যুদ্ধের সমাপ্তি তত্ত্বাবধান করেন। ১৯৬৯ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলাকালীন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং অবশেষে স্থলযুদ্ধে মার্কিন সেনা হ্রাস করার জন্য “ভিয়েতনামীকরণ” প্রক্রিয়া শুরু করেন। তিনি কম্বোডিয়া এবং লাওসে যুদ্ধের বিস্তার ঘটান। ১৯৮২ সালে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময় একটি বহুজাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনির অংশ হিসাবে লেবাননে মেরিনদের মোতায়েন করেছিলেন। ১৯৮৩ সালে বেইরুট ব্যারাকে বোমা হামলার পর মিশনটি শেষ হয়েছিল। ১৯৮৩ সালেই রেগান একটি মার্কসবাদী সরকারকে উৎখাত করার জন্য পূর্ব ক্যারিবিয়ান সাগরের ওয়েস্ট ইন্ডিজের একটি দ্বীপ-দেশ গ্রেনাডায় আক্রমণ শুরু করেন। হস্তক্ষেপ সংক্ষিপ্ত কিন্তু বিতর্কিত ছিল। ১৯৮৯ সালে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ মাদক পাচারে জড়িত এবং গণতন্ত্র দমন করার জন্য অভিযুক্ত পানামার রাষ্ট্রপ্রধান ম্যানুয়েল নরিয়েগাকে অপসারণের জন্য পানামা আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৯৯০ সালে জর্জ এইচডব্লিউ বুশ কুয়েত থেকে ইরাকি বাহিনিকে বিতাড়িত করার জন্য একটি জোটের নেতৃত্ব দেন। এই যুদ্ধটি সংক্ষিপ্ত ছিল কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপকে চিহ্নিত করে। নিউইয়র্কে ৯/১১ হামলার প্রতিক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের অধীনে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, আল-কায়দা এবং তালিবানকে লক্ষ্য করে। যুদ্ধটি একাধিক প্রশাসনের অধীনে চলতে থাকে এবং ২০২১ সালে ডেমোক্রাট প্রেসিডেন্ট জো বিডেনের আমলে শেষ হয়। এছাড়াও জর্জ ডব্লিউ বুশ দ্বারা শুরু করা এই যুদ্ধের (২০০৩-২০১১) লক্ষ্য ছিল গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মজুত আছে, এই মিথ্যা তথ্যের আঁধারে সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা। ওবামার অধীনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী দখলদারিত্ব এবং পাল্টাপাল্টি অভিযান অব্যাহত ছিল।
নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট কমলা বিজয়ী হলে বাইডেনের নীতির ধারাবাহিকতা বজায় থাকতে পারে বলে মনে করছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। গেল চার বছরে বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতির একটি বড় অংশ ছিল বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়া। দুই প্রার্থীর মধ্যে কিছু ইস্যুতে মিল রয়েছে। একটি হলো চীন। কমলা ও ট্রাম্প দুজনই চীনকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন। পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আগ্রাসী আচরণ জাপান ও ফিলিপিন্সের মতো মার্কিন মিত্রদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, তাইওয়ানে চীনা হস্তক্ষেপ নিয়েও বেশ সোচ্চার মার্কিন প্রশাসন। তাদের মধ্যে আর একটি বিষয়ে মিল পাওয়া যায়, তা হলো নব্য উদারনৈতিক অর্থনৈতিক নীতি। দু’জনই এই নীতি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ট্রাম্প-কমলা দুজনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আরো শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রতিরক্ষা খাতের আধুনিকায়নে নানা পরিকল্পনার কথা বলেছেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিকাশকে এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তারা। ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান দুজনেরই।
মোদ্দাকথা, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি প্রায়শই প্রশাসনে কর্তৃত্বের পরিবর্তন হলেও স্থিতিশীল থেকেছে। যদিও দৃষ্টিভঙ্গি এবং গুরুত্বপ্রদানের ক্ষেত্রে সূক্ষ্ম তারতম্য উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। ডেমোক্রাটিক এবং রিপাবলিকান উভয় প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, সামরিক শক্তি এবং কৌশলগত জোটে মার্কিন আধিপত্য সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যগুলি ভাগ করে নেন। এই উদ্দেশ্যগুলি অর্জনের জন্য অগ্রাধিকার এবং কৌশলগুলি প্রায়ই দলীয় মতাদর্শ, রাজনৈতিক চাপ এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের উপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হয়, মূল নীতিকে অক্ষত রেখে। উভয় দলই জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রভাব এবং বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার অনুকূল ভারসাম্য বজায় রাখাকে অগ্রাধিকার দেয়। এই লক্ষ্যগুলি বিশ্বব্যাপী বাজারে মার্কিন প্রবেশাধিকার রক্ষা, প্রতিকূল শক্তির উত্থান রোধ এবং গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলিতে স্থিতিশীলতার প্রচারের মূলে রয়েছে। প্যালেস্তাইন, লেবাননে ইজরায়েলের সন্ত্রাসবাদী গণহত্যার প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যক্কারজনক ভূমিকা সেদেশের দীর্ঘমেয়াদি বিদেশনীতির আধারেই। এক্ষেত্রে প্রয়োগকৌশলে কিছু তারতম্য থাকলেও মূল ভাবনায় কোনও দ্বিমত নেই ডেমোক্রাটিক ও রিপাবলিকানদের মধ্যে। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং তাঁর চরম দক্ষিণপন্থী দোসররা না চাইলে, কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট হলেও গাজা, লেবাননে মৃত্যুমিছিল থামবে না। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে কমলা হ্যারিস বা ডোনাল্ড ট্রাম্প- যেই হোন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট,গুরুত্ব পাবে আমেরিকান আধিপত্যবাদই।