কলকাতা যেন আচমকা পাল্টে রাজস্থানের জয়সলমের হয়ে গিয়েছে৷ শহরের বুকে গত দশ দিন ধরে একটানা তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে৷ আলিপুর আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এমন পরিস্থিতি শেষ দেখা গিয়েছিল ২০১৯ সালে৷ তার আগে ২০০৯ সালেও টানা আটদিন তাপপ্রবাহের সাক্ষী ছিল তিলোত্তমা৷
প্রসঙ্গত, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়ালে ও দিনের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ৪.৫ ডিগ্রি বেশি হলে তা তাপপ্রবাহ হিসেবে বিবেচিত হয়৷ মঙ্গলবারও একই পরিস্থিতি থাকলে এপ্রিল মাসের আগের সব রেকর্ডগুলি যাবে ভেঙে৷ সোমবার শহরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪১.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ কিন্ত্ত মোবাইল বলছে, ‘ইটস ফিল লাইক ৪৬৷’ কোনও কোনও দিন আর্দ্রতার কারণে ঘেমে নেয়ে একসা৷ আবার কোনওদিন শুকনো ঠোঁট-মুখ-চোখ জ্বালানো হাড়জ্বালানি গরম৷ হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচতে রোদ চশমা, ছাতা ব্যবহারের পাশাপাশি মেয়েরা স্কার্ফ ও রুমালে মুখ ঢেকে চলাফেরা করছেন৷ বিক্রি বেড়ে গিয়েছে ছাতা, সানগ্লাস, স্কার্ফ, ওড়না, তোয়ালে ও টুপির৷
রাস্তায় গলছে পিচ৷ দীর্ঘপথে দূরের দিকে তাকালে মনে হয় ধোঁয়ায় তিরতির করে কাঁপছে দূরের রাস্তা৷ সূর্যের তেজ আরও কড়া হয়ে উঠছে৷ শহরে কার্যত লু’র পরিস্থিতি৷ আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, আগামী কয়েকদিনেও কলকাতাসহ গাঙ্গেয় বঙ্গ ও গৌড়বঙ্গে ঝড়বৃষ্টির কোনও সম্ভাবনা নেই৷ শুকনো গরম হাওয়ার স্রোত চলতে থাকবে৷ তাপপ্রবাহের জ্বলুনিও চলবে৷ কবে ঝড়বৃষ্টির স্বস্তি মিলবে, তার হদিশ এখনও দিতে পারেননি আবহবিদরা৷ আবহ বিজ্ঞানীরা বলছেন, পশ্চিম দিক থেকে যেভাবে গরম হাওয়া বায়ুমণ্ডলের নীচুস্তরে ঢুকছে তাতে জলীয় বাষ্পের দফারফা হচ্ছে৷ দিনের বেলা জলীয় বাষ্পের আধিক্য না থাকলে কালবৈশাখীর সম্ভাবনাও দূরঅস্ত৷
আবহবিদরা বারবারই বলছেন, বঙ্গোপসাগরের জলীয় বাষ্প বায়ুমণ্ডলে না ঢোকার ফলেই ঝড়বৃষ্টির উপযোগী মেঘ তৈরি হচ্ছে না৷ পশ্চিমবঙ্গের উপকূল লাগোয়া সাগরে আসতে পারছে না উচ্চচাপ বলয়৷ কবে তা আসবে, তাও আপাতত অজানা৷ তাঁদের মতে, যেভাবে গরম হাওয়ায় স্রোত আসছে, তাকে ঠেলে জলীয় বাষ্প ঢোকা আপাতত কঠিন৷
দিল্লির মৌসম ভবনের বিজ্ঞানীদের অনেকে মনে করেন, এক বছরের চরিত্র দেখে কোনও ঋতুর চরিত্র বদল নিয়ে পাকাপাকিভাবে কোনও সিদ্ধান্তে আসা যায় না৷ তবে খানিকটা সেই ইঙ্গিত দিয়ে বছরখানেক আগে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রমিত দেবনাথ, রনিতা বর্ধনের নেতৃত্বে একদল গবেষক দেখিয়েছিলেন যে, তাপপ্রবাহের জেরে গ্রীষ্ম ক্রমশ প্রখর থেকে প্রখরতর হচ্ছে৷ তার জেরে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা যেমন উত্তরোত্তর বাড়ছে, তেমনই এই পরিস্থিতি সুস্থায়ী বৃদ্ধি ও উন্নয়নের পক্ষেও বাধা৷ কৃষি-আবহবিদরা মানছেন, ঋতুর বৈশিষ্ট্যের উপরে পশ্চিমবঙ্গসহ গোটা দেশেই চাষাবাদ নির্ভরশীল৷ এবার যেভাবে এখনও পর্যন্ত দক্ষিণবঙ্গে শুকনো গরম টানা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এবং দিনের পর দিন ছিটেফোঁটা বৃষ্টিও হচ্ছে না, তাতে কৃষিক্ষেত্রে ক্ষতির আশঙ্কা থাকছেই৷
আবহবিদরা বলছেন, এত দীর্ঘ তাপপ্রবাহ গাঙ্গেয় বঙ্গে আগে দেখা যায়নি৷ সামগ্রিকভাবে গরমের চরিত্রই যেন বদলে গিয়েছে৷ সকালের পর থেকেই ক্রমাগত লু৷ হু হু করে পারদ চড়ছে৷ সন্ধ্যার পর জলীয় বাষ্প ঢুকে ঘামের অস্বস্তি বাড়াচ্ছে৷ তৈরি হচ্ছে গুমোট ভাব৷ শুকনো গরম হাওয়ার দাপটে সেই জলীয় বাষ্প যেন চট করে উবে যাচ্ছে৷ প্রখর গরম থেকে বাঁচতে পর্যাপ্ত জলপান, রোদ এড়িয়ে চলা, মশলাদার খাবার না খাওয়া, সুতির পোশাক পরার পরামর্শ দিয়েছে হাওয়া অফিস এবং প্রশাসন৷
আবহবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ বলছেন, চলতি সপ্তাহের শেষ থেকে পরিস্থিতি কিছুটা বদলে যেতে পারে৷ কিছু বেসরকারি অফিসও পূর্বাভাসে তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে৷ তবে সেই পূর্বাভাস কতটা মিলবে তা স্পষ্ট হতে আরও দিন তিনেক অপেক্ষা করতে হবে৷ তেমন হলে আগামী সপ্তাহের গোড়ার দিকে স্বস্তির বার্তা দিতে পারে প্রকৃতি৷ এই আশাতেই ভরসা করে হাড়জ্বালানো গরমেও শহরবাসী এখন চাতক পাখি৷