গ্র্যান্ডমাস্টার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক : ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কি হতে চলেছে?

পঙ্কজকুমার চট্টোপাধ্যায়: ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী সারা দেশে এক অনন্য নজিরের অধিকারী৷ ওড়িশায় তাঁর শাসন এখন ২৪তম বছরে পদার্পণ করেছে৷ তাঁর দল বিজেডি দীর্ঘ ২৫ বছরে কোনও নির্বাচনে হারেনি৷ বরং অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সিকে কলা দেখিয়ে নবীন পট্টনায়ক প্রতি নির্বাচনে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন৷ বর্তমানে তিনি দেশে সবচেয়ে বেশিদিন একনাগাড়ে শাসনে থাকা মুখ্যমন্ত্রী৷

আত্মপ্রচার বিমুখ হয়ে নিজের রাজ্যের উন্নয়নে নিরন্তরভাবে সাফল্যের সঙ্গে তিনি কীভাবে কাজ করেছেন এবং নিজের ও রাজ্যের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে তৎপর হয়েছেন তার কিছু উদাহরণ দিয়েই আমি আমার বক্তব্য পেশ করব৷

যশ ঝড়ের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে নবীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বলেন যে তিনি কোভিড-১৯ অতিমারিতে ভারাক্রান্ত কেন্দ্রের ভার আর বাড়াতে চান না৷ পরিবর্তে তিনি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে এক মজবুত বিদু্যৎ ব্যবস্থা এবং ৪৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ রাজ্যের সমুদ্রতীরে স্থায়ী বাঁধের ব্যবস্থা করতে কেন্দ্রকে অনুরোধ জানান৷ যদিও প্রধানমন্ত্রী প্রথামতো নিজের থেকে ত্রাণের জন্য ৫০০ কোটি মঞ্জুর করেন৷ যশের মোকাবিলার পরিপ্রেক্ষিতে ইউএনডিআরআর-এর মামি মিজুতোরি বলেন, ‘পট্টনায়েক নিঃসন্দেহে এক বলিষ্ঠ এবং সংস্থানসম্পন্ন বিপর্যয় মোকাবিলা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন৷’
কোভিড ভ্যাকসিন প্রস্ত্তত করার জন্য তিনি সারা দেশের হয়ে ‘গ্লোবাল টেন্ডার’ ডেকেছিলেন৷ স্বাভাবিকভাবে কোনও প্রস্ত্ততকর্তা সরাসরি কোনও রাজ্যের আমন্ত্রণে সাড়া দেননি৷ তবুও এই প্রয়াসে তিনি এক ঐকমত্য গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন এবং স্বাভাবিকভাবে তাঁর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়৷
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তিনি মহিলা প্রার্থীদের জন্য ৩৩% আসন সংরক্ষণের কথা ঘোষণা করে বাজিমাত করে দেন৷ ২০২৪ সালের নির্বাচনেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে৷ এক অভিনবত্ব দেখিয়ে মহাত্মা গান্ধির ১৫০তম জন্মবার্ষিকী পালনের জন্য গঠিত কমিটির প্রথম সভায় তিনি সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘অহিংসা’ শব্দটি জুড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন৷


১৯৯৭ সালে বিজেডি দল গঠিত হওয়ার পর থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তাঁর দল এনডিএ-র জোটে ছিল৷ ২০০০ সালে তিনি যখন প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন তখন রাজ্যের অবস্থা অনেক দিক থেকেই ভাল ছিল না এবং রাজনীতিতে তিনি তখনও পোক্ত হননি৷ একবার নিজের পায়ের তলায় মাটি পাওয়ার পর তিনি ২০০৯ সালে এনডিএ জোট ত্যাগ করেন৷ কিন্ত্ত তিনি কখনও বিরোধী জোটে প্রত্যক্ষভাবে যোগ দেননি এবং নিজেকে বিরোধী নেতা হিসেবে ভাবতেও চাননি৷ অন্যদিকে তিনি জোট ত্যাগ করলেও সংসদে এনডিএ-র পাশে থেকেছেন এবং ইউপিএ জমানাতেও কেন্দ্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন৷ তাঁর কথায়, ‘আমি ৪.৫ কোটি রাজ্যবাসীকে সেবা করতে পেরে খুশি৷’

নিজের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বজায় রাখার পাশাপাশি এক অনন্য মানবিক ভাবমূর্তিও তিনি গড়ে তুলেছেন৷ খুব সম মানুষেরই স্মরণে আছে যে ২০০০ দশকের মাঝামাঝি এক যৌনকর্মীকে নির্যাতন করে ভুবনেশ্বরের রাস্তায় চলন্ত গাড়ি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়৷ স্থানীয় পুলিশ মন্তব্য করেছিল যে এটি ‘খদ্দের’ এবং যৌনকর্মীর মধ্যে বিবাদের ঘটনা৷ ঘটনার সংবাদ প্রচারের কয়েক মিনিটের মধ্যে ডিজিপি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়ে দেখা করেন এবং সংবাদমাধ্যমে সঠিক ঘটনা বিবৃত করেন যে এটি একটি নারী নির্যাতনের ঘটনা এবং অপরাধীরা দ্রুত ধরা পড়ে৷ রুষ্ট নবীন তাঁর হস্তক্ষেপের মাধ্যমে যৌনকর্মীর প্রতি সমবেদনা এবং মর্যাদা প্রকাশ করেন৷

সম্বলপুরের এক আদিবাসী যুবক শেষা কিষেণের পাশে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন৷ তিনি জার্মানির এক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান৷ গত বছর নির্বাচনী বক্তৃতায় তিনি এক কৃতী ওড়িয়া সন্তানের নাম করেন৷ শেষা নবীনকে নিজের পিতার মতো মনে করেন৷ শিক্ষাজীবনের শেষে শেষা কয়েক বছর বিভিন্ন সংস্থায় কজা করার পরে ওড়িশায় তাঁর ওষুধ প্রস্ত্ততকারক কোম্পানি ‘শেষা কিষেণ ফার্মা প্রাইভেট লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা করেছেন৷

পট্টনায়কের নেতৃত্বে ওড়িশা অনাহারে মৃতু্য থেকে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করেছে৷ সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির অনুগ্রহে থাকা রাজ্যকে বিপর্যয় ব্যবস্থাপনায় এক পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে৷ নিজের দলের এমপি পিনাকী মিশ্রের কথায়, ‘আমি তাঁর কর্মজীবনের প্রগতি প্রত্যক্ষ করেছি৷ তিনি খুব নিয়মনিষ্ঠ৷ তিনি এক দাবাড়ুর মতো, তিনি জানেন সঠিক সময়ে কোন গুটিটা নড়াতে হবে৷ এক গ্র্যান্ডমাস্টারের মতো, তিনি একই সঙ্গে অনেক খেলোয়াড়ের সঙ্গে খেলতে পারেন, প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রত্যেকের উপযোগী চাল ঠিক করে৷’

৫০ বছর বয়স পর্যন্ত দিল্লির ওবেরয় হোটেলের এক বুটিকের ব্যবসা নিয়ে এক শান্ত জীবন কাটছিল তাঁর৷ ১৯৯৭ সালে পিতা মারা যাওয়ার পরে তদনীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রকুমার গুজরালের অনুরোধে তিনি পিতা কেন্দ্র আকসা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে রাজি হন৷ পাশাপাশি গঠিত হয় বিজু জনতা দল৷ পোশাক হয় কুর্তা পাজামা৷

অনাড়ম্বরভাবেই তিনি রাজ্য শাসন করেন৷ তাঁর সচিবালয়ে বহু বছর থেকে টিকে আছে তাঁর বসার জন্য চামড়া ছেঁড়া কাঠের চেয়ার৷ তাঁর ঘর সংস্কৃতি, ইতিহাস, রাজনীতি এবং নীতির পুস্তকে ভর্তি৷ মন্ত্রীসভার ঘরেও দীর্ঘদিন কোনও পরিবর্তন হয়নি৷ শুধু ভাঙা টাইল পাল্টানো হয়েছে৷ স্বাভাবিকভাবে রং মেলেনি৷ এক বু্যরোক্রাটের কথায়, ‘আমরা তাঁকে চেয়ার পাল্টাতে এবং ঘরের নবীকরণের জন্য অনেক অনুরোধ করেছি, কিন্ত্ত তিনি শোনেননি৷

দীর্ঘ অনেক বছর ধরে তিনি যে সরকারি মারুতি এসটিম গাড়ি ব্যবহার করেন তার অবস্থাও ভালো নয়৷ এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী বলেন, ‘ছয় ফুট লম্বা হওয়ায় তাঁর এই গাড়িতে প্রবেশ করতে অসুবিধা হয়৷ অতঃপর একদিন বৃষ্টিতে গাড়িটি বসে যায়৷ তখন এসইউভি-র পরিবর্তে তিনি আগের গাড়ির সমতুল নতুন মারুতি সুজুকি এসএক্স-৪ কেনেন৷’ এমপি পিনাকী মিশ্র আরও বলেন, ‘গান্ধিজির সুখের জীবন ত্যাগ করতে ২০ বছর লেগেছিল৷ আর নবীনজি রাতারাতি এই কাজ করেছিলেন ১৯৯৭ সালে৷’
এক অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার এবং মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান পরামর্শদাতা আর বালাকৃষ্ণণের কথায়, ‘রাজ্য আগে প্রান্তিক অবস্থায় ছিল৷ কোনও বড় কোম্পানি বা রাষ্ট্রীয় সংস্থার এই রাজ্যে প্রধান কার্যালয় ছিল না৷ নবীনের শাসন দক্ষতায় রাজ্য এখন প্রান্তিক অবস্থা কাটিয়ে মধ্যমণি হয়ে উঠেছে৷ হকি বিশ্বকাপ, মন্দির সংস্কার এবং পথিকৃৎ নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে রাজ্য আজ সবার কাছে আদরনীয়৷
অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠার প্রতু্যত্তরে তিনি এক মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছেন৷ নরেন্দ্র মোদি ২২ জানুয়ারি রামমন্দির উদ্বোধন করেন৷ আর তার পাঁচদিন আগে নবীন উদ্বোধন করেছেন ৪ হাজার কোটি টাকায় নির্মিত বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের ‘পরিকল্পনা প্রকল্প’ ও ‘শ্রী সেতু’ সংযোগ৷ যথার্থই তাঁকে রাজনীতির খেলায় এক সেরা দাবাড়ু বলা হয়৷ শুধু তাই নয়, এর সঙ্গে আছে ২ হাজার কোটি টাকায় ভুবনেশ্বর লিঙ্গরাজ মন্দির, কোনারকের সূর্য মন্দির, সম্বলপুরের সমলেশ্বরী, পুরীর গুন্ডিচা, রেমুনার ক্ষীরচোরা গোপীনাথসহ রাজ্যের প্রত্যেকটি প্রধান মন্দিরের সংস্কার কর্ম৷
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন মাথায় রেখে চমক দেখিয়ে নতুন বিরোধী জোট ‘আইএনডিআইএ’ বা ‘ইন্ডিয়া’ তৈরি হয়েছে, তার জৌলুস ইতিমধ্যেই অন্তর্হিত হয়েছে৷ নবীন পাকা দাবাড়ুর মতো নিজের দুর্গ সুরক্ষিত রেখে দূর থেকে দেখে যাবেন আসন্ন নাটকের অভিনয়, অদৃশ্য অভিনেতা হিসেবে দর্শকের আসনে বসে৷