শ্রীধর মিত্র
বঙ্গের পথে ঘাটে বেপরোয়া বে-সরকারি বাস-গাড়ি ও অন্যান্য গাড়ির চালকের গাফিলতির কারণে পথচলতি পথচারীর অথবা যাত্রীর মৃত্যু হলে সেই ক্ষেত্রে বাস চালকের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করতে হবে পুলিশকে। এ যাবৎ এ ধরনের পথ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে চালকদের বিরুদ্ধে সাধারণত অনিচ্ছাকৃত মৃত্যুর ঘটনার অভিযোগ দায়ের করা হতো! এখন থেকে গাড়ির চালকের বিরুদ্ধে সরাসরি শুধু মালিকের বিরুদ্ধেও তদন্ত হবে—নড়েচড়ে বসেছে বঙ্গ সরকার। সম্প্রতি শহর ও শহরতলিতে বেশ কয়েকটি মারাত্মক পথ-দুর্ঘটনায় বেশ কয়েকজনের প্রাণ হারিয়েছে। চলতি মাসের ১২ তারিখে উল্টোডাঙ্গার হাডকোর মোড়ে বে-সরকারি ২১৫ ও ২১৫এ বাসের রেষারেষিতে চতুর্থ শ্রেণির ১০ বছরের স্কুল ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় উত্তরবঙ্গ সফরে থাকা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং ঘাতক বাস চালকের বিরুদ্ধে সরাসরি খুনের মামলা দায়ের করার নির্দেশ দিয়েছিলেন পুলিশকে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই এ রকম পথ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে গত ১৪ নভেম্বর পরিবহণ মন্ত্রী স্নোহাশিস চক্রবর্তীকে জরুরী ভিত্তিতে বে-সরকারি বাস মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওই বৈঠকে কলকাতার মহানাগরিক তথা পুরনগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরাদ হাকিমকে বঙ্গ পুলিশের মহানির্দেশক রাজীব কুমার, পরিবহণ সচিব সৌমিত্র ও কলকাতা বিধাননগরের নগরপাল মনোজ বর্মা ও মুকেশ কুমার সহ পরিবহন বিভাগের শীর্ষ আধিকারিকদের নিয়ে বে-সরকারি বাস-লরি-ট্যাক্সি-অ্যাব ক্যাব-বাইক-অটো সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক সেরেছিলেন সল্টলেকের নগরোন্নয়ন ভবনে। বৈঠকের পরে কলকাতার মহানাগরিক তথা পুরমন্ত্রী ফিরাদ হাকিম রাতে জানিয়েছিলেন যে, স্কুল-কলেজের পড়ুয়াদের নিরাপত্তার স্বার্থে কলকাতা-বিধাননগরের সমস্ত স্কুলের নির্দিষ্ট সময় ছুটির সময় পরিবর্তন আনা একান্ত প্রয়োজন। মহানাগরিকের মতে, বিভিন্ন স্কুলের ছুটির সময়ের মধ্যে আধঘণ্টা থেকে ৪০ মিনিটের পার্থক্য থাকলে গাড়ির সংখ্যা যেমন কম হবে, বিপরীতে পুলিশের নজরদারি চালাতে সুবিধাও হবে। পুলিশের কাছে স্কুল ছুটির সময় আরও বেশি করে নজরদারির অনুরোধ রেখেছেন পরিবহন বিভাগের শীর্ষ আধিকারিকরা। বঙ্গ পুলিশের মহা-নির্দেশক রাজীব কুমার ওই দিনের বৈঠকে বাসের রেষারেষিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পরিযাণ বা (ট্রাফিক) মনিটারিং সিস্টেম চালুর প্রস্তাব রেখেছেন। সমস্ত রাস্তায় সিসিটিভি ক্যামেরা, প্রয়োজনে তিনি বে-সরকারি বাসেও GPF বসানোর কথাও বলেছেন। ওই দিনের সন্ধ্যায় নগরোন্নয়ন ভবনে বৈঠক চলাকালীন উত্তরবঙ্গ থেকে মুখ্যমন্ত্রী ফিরাদ হাকিমকে দু-বার ফোন করে বৈঠক সম্বন্ধে খোঁজখবর নিয়েছিলেন। পথে-ঘাটে পথ দুর্ঘটনা রোধ করতে সাধারণ পথচারিদের আরও বেশি করে সচেতন করতে সরকারের তরফ থেকে প্রচারমূলক কর্মসূচির মধ্যমে অবগত করার একান্ত প্রয়োজন। বাস সহ অন্যান্য পরিবহনের রেষারেষি রুখতে পাবলিক ভিকেল্স বিভাগ থেকে (PVD) গাড়ির ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর (SOP) তৈরির বিষয়েও কেসে আলোচনাও হয়েছে। পরিবহন মন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী জানিয়েছেন যে, ‘বেপরোয়াভাবে বাস সহ অন্যান্য পরিবহনের ক্ষেত্রে কোন পথচারীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে ওই পরিবহনের চালকের বিরুদ্ধে সরাসরি খুনের মামলা দায়ের করার পক্ষে পরিবহনে বিভাগ। দিনের পর-দিন পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে। বেহালা, বাঁশদ্রোণী, উল্টোডাঙ্গা, ইএমবাইপাস, গড়িয়া সহ বঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে রেহাই পাচ্ছে না স্কুল পড়ুয়ারাও। বেপরোয়া গাড়ি চালালে গাড়ির চালকের বিরুদ্ধে গাড়ির লাইসেন্স বাতিল, নিয়মিত চালকদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা, বাস চালকদের কমিশন প্রথা বন্ধ করতে হবে, উপযুক্ত গাইডলাইন এবং আগামীদিনে চালকদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের হবে। এ ব্যাপরে ট্রাফিক পুলিশদের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।
পরিবহন মন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরেই, পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তায় যাত্রী পরিবহনে বে-সরকারি বাস নামিয়ে জেলে যাওয়ার ভয়ে-ভীত-সন্ত্রস্ত বাস চালক ও কন্ডাক্টাররা ও অন্যান্য শ্রমিকরা। ৫০টি বে-সরকারি রুটের মালিকরা আলোচনায় বসেছিলেন সোমবার গড়িয়াহাটে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা না করলেও, ওই রুগ্ন পরিবহন শিল্পেকে বাঁচাতে আন্ত সমাধান সূত্র বার করাই বাস মালিকদের মূল লক্ষ, চালকদের বেপরোয়া বাস চালানো বাস মালিকরা কোনও মতেই সমর্থন করেন না সুবার্বান বাস সার্ভিস সগঠন। বাসের রেষারেষি কখনই কাম্য নয়। অথচ কলকাতা সহ জেলা স্তরে সংকীর্ণ রাস্তায় চুড়ান্ত মানসিক চাপ নিয়েই প্রতিদিনই যাত্রী বোঝাই বাস চালাতে হয়। এ যেন বাস চালকদের প্রতিদিনের পরীক্ষার সামিল। তাঁদের ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলার মতোই, কিন্তু বাসযাত্রীরা রীতিমতো হুমকির সুরে নিদান দেন, ট্রেন ধরার আছে বাস দ্রুত গতিতে চালান আস্তে আস্তে চালাচ্ছেন কেন? অথচ বাসযাত্রীদের হৈ-চৈ-চেঁচামেচিতে জোরে বাস চালালে কোনও পথ দুর্ঘটনা হলে তার দায় কে নেবে?
বে-সরকরি বাস মালিকরা কলকাতায় বৈঠকে বসে সম্প্রতি পথ-দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে বঙ্গ সরকারের তরফ থেকে যে ফতোয়া জারির কথা বলা হয়েছে তাতে বাস মালিকরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, তাদের পালটা অভিযোগ বে-সরকারি বাসের দুর্ঘটনার ফলে মৃত্যুর জন্য এক শ্রেণির বাস চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, এমনই দাবি করে বে-সরকারি বাসের ক্ষেত্রে চালক-কন্ডাক্টারদের কমিশন ব্যবস্থা তুলে দেবার কথা বঙ্গ সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, বে-সরকারি বিভিন্ন বাস রুটের পারমিট (ছাড়পত্র) পাওয়ার শর্ত হিসাবে বাস মালিকদের নির্দিষ্ট নিয়মবিধি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর মেনে চলার বিষয় সম্মতি দিতে হবে। তারপরেও বাসচালকদের বেপরোয়া চালানোর ফলে পথ দুর্ঘটনায় কোন যাত্রী অথবা পথচারীদের মৃত্যু হয় সেখানে অভিযুক্ত বাসচালকের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করা হবে বলে বঙ্গ সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। বাস মালিকদের দাবি, বাস দুর্ঘটনার সঙ্গে বে-সরকারি বাসের কর্মীদের কমিশন প্রথার কোন সম্পর্ক নেই। সরকারি বাস, ট্রাক, ট্যাক্সি, অটো, ক্যাব, মালবাহি গাড়ি সহ নানা পরিবহনের ক্ষেত্রে চালক ও সহকারিরা নির্দিষ্ট ভাতা পেয়ে থাকেন। তার পরেও ওই সব গাড়িতে দুর্ঘটনা ঘটে বলে দাবি বাস মালিকদের। বে-সরকারি বাসমালিকদের সংগঠন ‘সিটি সুবার্বন বাস সার্ভিসের সাধারণ সম্পাদক টিটু সাহা বলেছেন—কমিশন প্রথা দুর্ঘটনার পেছনে একমাত্র কারণ নয়। পথে গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে উপযুক্ত শৃঙ্খলা আনতে না পারলে পথ দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল।’ সরকারি নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাস মালিকদের ভাবনাও যাতে বিবেচিত হয়, তা দেখতে পরিবহণ মন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের সমস্যার কথা জানাবেন খুব শীঘ্রই।