শোভনলাল চক্রবর্তী
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রাসায়নিক নাইট্রোজেন সারের বিকাশ কৃষিক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লবের সূচনা করে। যা খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করে ক্রমবর্ধমান বিশ্ব জনসংখ্যার খাবারের জোগান দেয়। তবে বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, কৃষি জমিতে যতখানি নাইট্রোজেন সার দেওয়া হয়, তার অধিকাংশই বায়ুমণ্ডলে মিশে যায় নাইট্রাস অক্সাইড হিসেবে। একবার নিঃসৃত হলে এই গ্যাস বায়ুমণ্ডলে অবস্থান করে মানুষের গড় জীবদ্দশার থেকেও বেশি সময় ধরে। ফলে পরিবেশ এবং ওজ়োন আস্তরণের উপরে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে।
শুধু তা-ই নয়, কৃত্রিম নাইট্রোজেন সার এবং পশু সারের অদক্ষ ব্যবহারের জেরে দূষিত হয়েছে ভূগর্ভস্থ পানীয়, এমনকি উপকূলবর্তী জল তথা জলাশয়। অন্যদিকে, মাংস এবং দুগ্ধজাত পণ্যের ক্রমাগত চাহিদা বাড়ার কারণে সার উৎপাদন বৃদ্ধি তথা পশুখাদ্য উৎপাদনেও নাইট্রোজেন সারের অতিরিক্ত ব্যবহার এই নিঃসরণে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি বা রাসায়নিক শিল্পক্ষেত্রের নিঃসরণ ততটা না পাল্টালেও, কৃষিক্ষেত্র থেকে নিঃসরণ বেড়েই চলেছে। এ কথা এখন মোটের উপর স্বীকৃত যে, বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে বেঁধে রাখতে বর্তমানে বিশ্বজুড়ে যাবতীয় প্রচেষ্টা চলছে কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং মিথেন গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যে।
ঠিক তখনই এক সমীক্ষা জানাচ্ছে এযাবৎ নিঃশব্দে অব্যাহত থেকেছে আর এক শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ— নাইট্রাস অক্সাইড। ‘গ্লোবাল নাইট্রাস অক্সাইড বাজেট ২০২৪’ নামক এক রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৮০ থেকে ২০২০— এই চার দশকে এই গ্যাসের নিঃসরণ বেড়েছে চল্লিশ শতাংশ।
রিপোর্টে এও জানা গিয়েছে, গত দশকে মোট নাইট্রাস অক্সাইড নিঃসরণের ৭৪ শতাংশ এসেছে কৃষিকাজে নাইট্রোজেন এবং পশু সার ব্যবহারের ফলে। মনুষ্য ক্রিয়ায় উদ্ভূত নাইট্রাস অক্সাইড নিঃসরণ বর্তমান উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে ০.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কার্বন ডাই-অক্সাইডের তুলনায় এই গ্রিনহাউস গ্যাসটির প্রায় ৩০০ গুণ বেশি উষ্ণায়নের ক্ষমতা থাকায় তা ঘোরতর উদ্বেগের কারণও বটে। বিজ্ঞানীদের দাবি, প্যারিস চুক্তি দ্বারা নির্ধারিত বিশ্ব তাপমাত্রার বৃদ্ধিকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের অনেকটা নীচে বেঁধে রাখতে হলে ২০৫০ সালের মধ্যে নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাসের নিঃসরণ অন্তত ২০ শতাংশ কমাতেই হবে। দুশ্চিন্তার আরও কারণ, বিজ্ঞানীদের মতে বর্তমানে এমন প্রযুক্তি তৈরি হয়নি যা এই গ্যাসকে বায়ুমণ্ডল থেকে সরাতে পারে।
উষ্ণায়নের প্রভাবে বিশ্ব জুড়ে আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাবটি ইতিমধ্যেই স্পষ্ট। তার থেকে পাহাড়ও যে রেহাই পাবে না, তা নিশ্চিত। কিন্তু প্রাকৃতিক সেই পরিবর্তনকে আরও উস্কে দিতে পারে, এমন বিবেচনাহীন কর্মকাণ্ডের খুব কি প্রয়োজন আছে? বহু বার বিশেষজ্ঞরা তিস্তা নদীর খাত পাথর, পলিতে ভরাট হয়ে আসার কথা বললেও আশ্চর্যজনক ভাবে সরকারের কাজ এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র একের পর এক বাঁধ নির্মাণেই আবদ্ধ। পাহাড়ের উন্নয়ন প্রয়োজন অবশ্যই, কিন্তু সেই উন্নয়নের বিপুল ভার সামলানোর জমিটি যথেষ্ট শক্তপোক্ত কি না, সেটা দেখে নেওয়াও একই রকম জরুরি। গুরুত্ব দিতে হবে জঙ্গল কাটায়, বাঁধ নির্মাণে স্থানীয়দের আপত্তিকে, কারণ ভূমিপুত্র হওয়ায় তাঁরাই সেখানকার মাটিকে চেনেন নির্ভুল ভাবে। দুর্ভাগ্য, রাজ্য, কেন্দ্র উভয় সরকারই এ বিষয়ে মাত্রাতিরিক্ত উদাসীন। সুতরাং, এই ধ্বংস, প্রাণহানি ঠেকানোর উপায়টিও আপাতত তিস্তাগর্ভেই বিলীন হয়ে গিয়েছে।
কেন বার বার বিধ্বস্ত হচ্ছে পাহাড়, এর উত্তরটি লুকিয়ে আছে সরকারি নানা সিদ্ধান্তের অন্দরে। যেখানকার যেমন ভূপ্রকৃতি, তার বিরুদ্ধে গিয়ে উন্নয়নের প্রচেষ্টা আত্মধ্বংসকারী। উত্তরাখণ্ড, হিমাচল থেকে সিকিম বার বার সেই প্রমাণই দিয়ে চলেছে। সিকিমের পাহাড় স্বভাবতই ধসপ্রবণ। সামান্য বর্ষাতেই পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে নামে মাটি, পাথরের স্রোত। ভূপ্রকৃতিগত সেই বৈশিষ্ট্যকে অগ্রাহ্য করে সেখানে পাহাড় ফাটিয়ে তৈরি হচ্ছে সেবক-রংপো রেলপথ। যে উত্তর সিকিম বার বার প্রকৃতির রোষে পড়ছে, সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে নির্বিচারে গাছ, পাহাড় কেটে চওড়া হয়েছে রাস্তা, গড়ে উঠেছে অগুনতি হোটেল। সেখানে পাহাড়ি নদীর দু’পাশের প্লাবনভূমি প্রায় চোখেই পড়ে না। নদীখাতের উপরে হুমড়ি খেয়ে গড়ে উঠেছে হোটেল, রেস্তরাঁ। অতিবৃষ্টিতে নদীর জল বৃদ্ধি পেলে বাড়িঘর ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার কারণটি তাই সহজবোধ্য। এই সমস্ত নির্মাণের পূর্বে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে বিপদের সম্ভাবনাগুলি খতিয়ে দেখা হয় কি না, সন্দেহ আছে।
গত অক্টোবরে হিমবাহ হ্রদ ফেটে উত্তর সিকিমে ভয়াল বন্যার স্মৃতি এখনও ফিকে হয়নি। তার মধ্যেই সিকিমে সাম্প্রতিক প্রবল বৃষ্টি, ধস ও ফুঁসতে থাকা তিস্তা ফের সেই বিপর্যয়ের দিনগুলি ফিরিয়ে দিল। অক্টোবর এবং জুন— তীব্রতা ও ব্যাপ্তির দিক থেকে দু’টি বিপর্যয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও ঘটনাপরম্পরা প্রায় একই। প্রবল বৃষ্টিতে উত্তরবঙ্গ থেকে সিকিম পৌঁছনোর গুরুত্বপূর্ণ ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক বন্ধ, উত্তর সিকিমে প্রবল বৃষ্টি ও ধসে ছ’জনের প্রাণহানি, তিস্তার জল বিপদসীমা পার করে কালিম্পঙেরও একাংশ ভাসিয়ে দেওয়া— প্রতি বছর এমনটিই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়াচ্ছে পাহাড়ের। সমতলের অসহনীয় গরমে পর্যটকরা পাহাড়ে স্বস্তি খুঁজতে গিয়েছিলেন। সেই স্বস্তি দুশ্চিন্তায় পর্যবসিত। প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া একাধিক পর্যটনকেন্দ্রকে খানিক স্বাভাবিক করে পর্যটকদের উদ্ধার করাই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সিকিম প্রশাসনের কাছে। উদ্ধারকাজ-অন্তে পর্যটকরা আপাতত বাড়ির পথে, বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে ভেঙে পড়া পরিকাঠামোকেও সুস্থ করার প্রচেষ্টা জারি আছে। কিন্তু প্রশ্নগুলো মিলিয়ে যায়নি— পরিবেশ বনাম উন্নয়নের সংঘাতের প্রশ্ন। উত্তরাখণ্ডের পথ পেরিয়ে আপাতত সেই প্রশ্ন পশ্চিমবঙ্গবাসীর একেবারে শিয়রে এসে পৌঁছেছে।