মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ থেকে

(১৮৪৫-১৮৪৬)
আমার বিশেষরূপে বেদ জানিবার জন্য বড়ই আগ্রহ জন্মিল। বেদের চর্চ্চা কাশীতে, অতএব সেখানে বেদ শিক্ষা করিবার জন্য ছাত্র পাঠাইতে আমি মানস করিলাম। এক জন ছাত্রকে ১৭৬৬ শকে কাশীধামে প্রেরণ করিলাম; তিনি তথায় মূল বেদ সমুদায় সংগ্রহ করিয়া শিক্ষা করিতে লাগিলেন। তাহার পর বৎসরে আর তিনজন ছাত্র তথায় প্রেরিত হইলেন। আনন্দচন্দ্র, তারকনাথ, বাণেশ্বর এবং রমানাথ, এই চারি জন ছাত্র।

যখন ইঁহাদিগকে কাশীতে পাঠাই, তখন আমার পিতা ইংলণ্ডে। তাঁহার বিস্তীর্ণ কার্য্যের ভার সকলই আমার উপরে পড়িল। কিন্তু আমি কোন কাজ কর্ম্ম ভাল করিয়া দেখিয়া উঠিতে পারিতাম না। কর্ম্মচারীরাই সকল কাজ চালাইত; আমি কেবল বেদ-বেদান্ত, ধর্ম্ম ও ঈশ্বর ও চরম-গতিরই অনুসন্ধানে থাকিতাম। বাড়ীতে যে একটু স্থির হইয়া বসিয়া থাকি, তাহাও পারিয়া উঠিতাম না। এত কর্ম্ম কাজের প্রতিঘাতেতে আমার উদাস ভাব আরো গভীর হইয়া উঠিয়াছিল। এত ঐশ্বর্য্যের প্রভু হইয়া থাকিতে আমার ইচ্ছা করিত না। সব ছাড়িয়া ছুড়িয়া একা একা বেড়াইবার ইচ্ছাই আমার হৃদয়ে রাজত্ব করিতে লাগিল। তাঁহার প্রেমে মগ্ন হইয়া একাকী এমন নির্জ্জনে বেড়াইব যে, তাহা কেহ জানিতেও পারিবে না; জলে স্থলে তাঁহার মহিমা প্রত্যক্ষ করিব, দেশভেদে তাঁহার করুণার পরিচয় লইব; বিদেশে, বিপদে, সঙ্কটে পড়িয়া তাঁহার পালনী-শক্তি অনুভব করিব,— এই উৎসাহে আমি আর বাড়ীতে থাকিতে পারিলাম না।

১৭৬৮ শকের শ্রাবণ মাসের ঘোর বর্ষাতেই গঙ্গাতে বেড়াইতে বাহির হইলাম। আমার ধর্ম্মপত্নী সারদা দেবী কাঁদিতে কাঁদিতে আমার নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলেন, ‘আমাকে ছাড়িয়ে কোথায় যাইবে? যদি যাইতেই হয় তবে আমাকে সঙ্গে করিয়া লও।’ আমি তাঁহাকে সঙ্গে লইলাম। তাঁহার জন্য একটা পিনিস ভাড়া করিলাম। তিনি, দ্বিজেন্দ্রনাথ সতেন্দ্রেনাথ এবং হেমেন্দ্রনাথকে লইয়া তাহাতে উঠিলেন। আমি রাজনারায়ণ বসুকে সঙ্গে লইয়া নিজের একটি সুপ্রশস্ত বোটে উঠিলাম। তখন দ্বিজেন্দ্রনাথের বয়স ৭ বৎসর, সতেন্দ্রেনাথের ৫ বৎসর, এবং হেমেন্দ্রনাথের ৩ বৎসর।


রাজনারায়ণ বসুর পিতার নাম নন্দকিশোর বসু। তিনি রামমোহন রায়ের একজন প্রিয় শিষ্য ছিলেন। তাঁহার সঙ্গে আলাপ, ও তাঁহার ধর্ম্মভাব নম্র ভাব দেখিয়া, আমি বড় সুখী হইয়াছিলাম। তিনি ১৭৬৬ শকে ব্রাহ্মধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি সর্ব্বদাই এই ইচ্ছা প্রকাশ করিতেন, — ‘যদি রাজনারায়ণ ব্রাহ্ম হয়, তবে বড় ভাল হয়।’ জীবিতাবস্থায় তিনি তাঁহার সে ইচ্ছার সফলতা দেখিয়া যাইতে পারেন নাই।

তাঁহার মৃত্যু হইলে রাজনারায়ণ বাবু সেই অশৌচ অবস্থায় আমার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছিলেন। আমি তাঁহাকে সেই সময়েই বন্ধু বলিয়া গ্রহণ করিলাম। তখনকার ইংরাজী শিক্ষিতদিগের মধ্যে তাঁহার বেশ প্রতিষ্ঠা ছিল।
(ক্রমশঃ)