মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ থেকে

পূর্ব প্রকাশিতের পর
[ গগনের থালে রবি-চন্দ্র দীপক জ্বলে, তারকা-মণ্ডল চমকে মোতি রে। ধূপ মলয়ানিল, পবন চামর করে, সকল বনরাজি ফুলন্ত জোতি রে। কেমন আরতি, হে ভবখণ্ডন, তব আরতি, অনাহত শব্দ বাজন্ত ভেরী রে। হরি-চরণ-কমল-বকরন্দ-লোভিত মন, অনুদিন তাহে মোর পিপাসা রে। কৃপা-জল দে চাতক নানককে, যেন হয় তব নামে মম বাসা রে।]

আরতি শেষ হইল; তখন সকলকে কড়া-ভোগ (মোহন-ভোগ) দিতে লাগিল। মন্দিরের মধ্যে এই প্রকার দিন রাত্রি সপ্ত প্রহর ঈশ্বরের উপাসনা হয়; মন্দির পরিষ্কার করিবার জন্য রাত্রির শেষ প্রহরে উপাসনা বন্ধ থাকে। ব্রাহ্মসমাজে সপ্তাহে দুই ঘণ্টা-মাত্র উপাসনা হয়; আর শিখদিগের হরিমন্দিরে দিন রাত উপাসনা। কাহারো মন বোকুল হয়; আর শিখদিগের হরিমন্দিরে দিন রাত উপাসনা। কাহারো মন বোকুল হইলে নিশীথে সময়েও সেখানে গিয়া উপাসনা করিয়া চরিতার্থ হইতে পারে। এই সদ্দৃষ্টান্ত ব্রাহ্মদিগের অনুকরণীয়।

এখন আর শিখদের কোন গুরু নাই। তাহাদের গ্রন্থ সকল তাহাদের গুরুস্থানে প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। তাহাদের শেষ গুরু, দশম গুরু, গুরু গোবিন্দ। তিনিই শিখেদের জাতিভেদ নিবারণ করেন, এবং তাহাদের মধ্যে ‘পাহল’ বলিয়া যে দীক্ষার প্রথা প্রচলিত আছে, তাহা তিনিই সৃষ্টি করেন। সেই পাহল আজও চলিয়া আসিতেছে। যে শিখ হইবে, তাহাকে আগে পাহল করিতে হইবে। পাহল প্রথা এইরূপ,— একটা পাত্রে জল রাখিয়া তাহাতে চিনি ফেলিয় দিতে হয়, এবং সেই জল খড়গ বা ছুরিকার দ্বারা নাড়িতে হয়, এবং যাহারা শিখ হইবে তাহাদের গাত্রে তাহা ছড়াইয়া দিতে হয়। তাহার পর তাহারা সেই চিনির জল সকলে এক পাত্রে পান করে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র, সকল জাতিই শিখ হইতে পারে; বর্ণ-বিচার নাই। মুসলমানও শিখ হইতে পারে। শিখ হইলেই তাহার উপাধি সিংহ হইয়া যায়।


শিখদের এই মন্দিরে কোন প্রতিমা নাই। নানক বলিয়া গিয়াছেন যে, ‘থাপিয়া ন জাই, কীতা ন হোই, আপে আপ্ নিরঞ্জন সোই’, তাঁহাকে কোথাও স্থাপন করা যায় না, কে তাঁহাকে নির্ম্মাণ করিতে পারে না, তিনিই সেই স্বয়ম্ভু নিরঞ্জন। কিন্তু আশ্চর্য্য এই যে, নানকের সেই সকল মহৎ উপদেশ পাইয়াও,— শিখেরা নিরাকার, ব্রহ্মোপাসক হইয়াও, — সেই গুরুদ্বারার সীমানার মধ্যে এক প্রান্তে শিব-মন্দির স্থাপন করিয়া ফেলিয়াছে। ইহারা কালী দেবীকেও মানিয়া থাকে। ‘পরব্রহ্ম জ্ঞান করিয়া সৃষ্ট কোন বস্তুর আরাধনা করিব না’, এই ব্রাহ্ম প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা কাহারো পক্ষে বড় সহজ নহে।

দোলের সময় এই মন্দিরের মধ্যে বড় উৎসব হয়। সেই সময়ে শিখেরা মদ্যপানে মত্ত হয়। শিখেরা মদ্যপায়ী, কিন্তু তাহারা তামাক খায় না, একেবারে হুকা ছোঁয় না, কলিকে ছোঁয় না। আমার বাসাতে অনেক শিখেরা আসিত। আমি তাহাদের কাছে গুরুমুখী ভাষা ও তাহাদের ধর্ম্ম শিক্ষা করিতাম। তাহাদের মধ্যে বড় ধর্ম্মের উৎসাহ দেখিতে পাইতাম না।

আমি অমৃতসরে রামবাগানের নিকট যে বাসা পাইয়াছিলাম, তাহা ভাঙ্গা বাড়ী, ভাঙ্গা বাগান, এলোমেলো গাছ,— জঙ্গলা রকম। কিন্তু আমার নবীন উৎসাহ, তাজা চক্ষু, সকলি তাজা সকলি নূতন সকলি সুন্দর করিয়া দেখিত। অরুণোদয়ে প্রভাতে আমি যখন সেই বাগানে বেড়াইতাম, যখন আফিমের শ্বেত পীত লোহিত কূলসকল শিশির-জলের অশ্রুপাত করিত, ঘাসের রজত কাঞ্চন পুষ্পদল উদ্যান-ভূমিতে জরির মছনদ বিছাইয়া দিত, যখন স্বর্গ হইতে বায়ু আসিয়া বাগানে মধু বহন করিত, যখন দর হইতে পাঞ্জাবীদের সুমধুর সঙ্গীত-স্বর উদ্যানে সঞ্চরণ করিত, তখন তাহাকে আমার এক গন্ধর্ব্বপুরী বোধ হইত। কোন কোন দিন ময়ূর ময়ুরীরা বন হইতে আসিয়া আমার ঘরে ছাদের একতলায় বসিত, এবং তাহাদের চিত্র-বিচিত্র দীর্র্ঘ পুচ্ছ সূর্য্যকিরণে রঞ্জিত হয়িা মৃত্তিকাতে লুটাইয়া থাকিত। কখনো কখনো তাহারা ছাদ হইতে নামিয়া বাগানে চরিত। (ক্রমশ)