মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ থেকে

পূর্ব প্রকাশিতের পর

আমি মনে করিলাম, এ বাড়ীটা বুঝি সাধারণের জন্য, এখানে যে-সে থাকিতে পায়; এই মনে করিয়া আমার জিনিস পত্র লইয়া সেই বাড়ীতে উঠিলাম। তাহার পর দিন দেখি যে, কাশীর প্রসিদ্ধ রাজেন্দ্র মিত্রের পুত্র গুরুদাস মিত্র আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছেন। ভাবিলাম, আমার এখানে আসিবার কথা ইনি কেমন করিয়া জানিলেন? আমি তাড়াতাড়ি উঠিয়া তাঁহাকে আদর করিয়া আমার নিকটে বসাইলাম।

তিনি বলিলেন যে, ‘আমাদের বড় সৌভাগ্য যে, আপনি আমাদের এ বাড়ীতে উঠিয়াছেন। এ বাড়ীর দরজা নাই, পর্দ্দা নাই, আবরণ নাই, হিম পড়িতেছে। না জানি রাত্রিতে আপনার কতই কষ্ট হইয়া থাকিবে। আপনার এখানে আগমন হবে, তাহা পূর্ব্বে জানিলে সকলি প্রস্তুত করিয়া রাখিতাম।’ তিনি অনেক শিষ্টাচার করিলেন, এবং সেই স্থান আমার বাসোপযোগী করিয়া দিয়া আমাকে বাধিত করিলেন। কাশীতে দশদিন ছিলাম, বেশ আরামে ছিলাম।


আমি একটা ডাক গাড়ী করিয়া ১৭ই অগ্রহায়ণ কাশী ছাড়িলাম। সঙ্গে যে সকল চাকর ছিল তাহাদিগকে বাড়ী ফিরাইয়া দিলাম; কেবল দুই জন চাকরকে সেই গাড়ীর ছাদে বসাইয়া লইলাম। কিশোরীনাথ চাটুয্যে এবং কৃষ্ণনগরের এক জন গোয়ালা, এই দুই জনকে সঙ্গ লইলাম। তাহার পর দিন সন্ধ্যার সময়ে এলাহাবাদের পূর্ব্বপারে পঁহুছিয়া, আমার গাড়ী একখানা পারের খেওয়ার নৌকাতে চড়াইয়া রাখিলাম। ভয়, পাছে ভোরে পরের নৌকা না পাই। আমি সেই নৌকার উপরে গাড়ীর মধ্যে রাত্রিতে নিদ্রাটা ভোগ করিলাম।

তাহার পর দিন প্রাতঃকালে সেই পারের নৌকা শিথিল ভাবে চলিয়া, বেলা দুই প্রহরের সময়ে ওপারে পঁহুছিল। দেখি যে, কেল্লার নীচে গঙ্গার চড়াতে অনেকগুলি ছোট ছোট নিশান উড়িতেছে। এই সকল ধ্বজা যজমানদিগের পিতৃলোকে সমুন্নত হইয়াছে বলিয়া পাণ্ডারা অর্থ সংগ্রহ করে। এই প্রয়াক তীর্থ। এই প্রসিদ্ধ বেণী ঘাট; এই ঘাটে লোকে মস্তক মুণ্ডন করিয়া শ্রাদ্ধ করে, তর্পণ করে, দান করে। আমার নৌকা পঁহুছিতে পঁহুছিতেই কতকগুলা পাণ্ডা আসিয়া তাহা আক্রমণ করিল, তাহাতে চড়িয়া বসিল।

একজন পাণ্ডা, ‘এখানে স্নানকর, মাথা মুণ্ডন কর,’ বলিয়া আমাকে টানাটানি করিতে লাগিল। আমি বলিলাম, ‘আমি এ তীর্থে যাইব না, মাথাও মুণ্ডন করিব না।’ আর একজন বলিল, ‘তীর্থে যাও আর না যাও, আমাকে কিছু পয়সা দাও।’ আমি বলিলাম, ‘আমি কিছুই দিব না; তোমার পরিশ্রম করিবার ক্ষমতা আছে, পরিশ্রম করিয়া খাও।’ সে বলিল, ‘হম্ পয়সা লেকে তব্ ছোড়েঙ্গে, পয়সা দেনে হী হোগা।’

আমি বলিলাম, ‘হম্ পয়্সা নহী দেঙ্গে, কিস্তরে লেওগে, লেও তো?’ এই শুনিয়া সে নৌকা হইতে লাফ দিয়া ডাঙ্গায় পড়িল, এবং দাঁড়িদের সঙ্গে গুণ ধরিয়া জোরে টানিতে লাগিল। খানিক টানিয়া আমার কাছে নৌকায় দৌড়িয়া আসিল; বলিল, ‘হম্ তো কাম কিয়া, অব্ পয়্সা দেও।’ আমি বলিলাম, ‘এ ঠিক হইয়াছে’; আমি হাসিয়া তাহাকে পয়সা দিলাম। দুই প্রহর বাজিয়া গেল, তখন এইরূপ কষ্ট করিয়া গঙ্গার পশ্চিম পারে নির্দিষ্ট খেওয়া ঘাটে উপস্থিত হইলাম। তাহার পরে দুই ক্রোশ গিয়া একটা বাঙ্গালা পাইয়া সেখানে বিশ্রাম করিলাম।

এলাহাবাদ ছাড়িয়া ২২শে অগ্রহায়ণে আগ্রাতে আসিয়া পঁহুছিলাম। আমার ডাকের গাড়ী দিন রাত্রি চলিত। মধ্যাহ্ন সময়ে পথের একটা গাছের তলায় রন্ধন করিয়া আহার করিলাম। আগ্রায় আসিয়া ‘তাজ’ দেখিলাম। এ তাজ পৃথিবীর তাজ। আমি তাজের একটা মিনারের উপর উঠিয়া দেখি, পশ্চিম দিক সমুদায় রাঙা করিয়া সূর্য্য অস্ত যাইতেছে; নীচে নীল যমুনা; মধ্যে শুভ্র স্বচ্ছ তাজ, সৌন্দর্য্যের ছটা লইয়া যেন চন্দ্রমণ্ডল হইতে পৃথিবীতে খসিয়া পড়িয়াছে।

আমি এই যমুনা দিয়া ২৬শে অগ্রহায়ণে দিল্লী যাত্রা করিলাম। পৌষ মাসের শীতে কোন কোন দিন আমি যমুনাতে অবগাহন করিতাম, তাহাতে আমার শরীরের রক্ত জমাট হইয়া যাইত। বজ্রা চলিত কিন্তু আমি যমুনার ধারে ধারে শস্য ক্ষেত্রের মধ্য দিয়া, গ্রাম ও উদ্যানের মধ্য দিয়া, হাঁটিয়া প্রকৃতির সৌন্দর্য্য দেখিতে দেখিতে যাইতাম। তাহাতে আমার মনের বড়ই শান্তি হইত।
১১ দিনে এই যমুনার তীরে মথুরাপুরীতে উপস্থিত হইলাম। মথুরাতে পঁহুছিয়া মথুরা দেখিতে চলিলাম। যমুনার ধারে সন্ন্যাসীদিগের সত্র আছে। সেই সত্র হইতে একজন সন্ন্যাসী আমাকে ডাকিতেছে, ‘ইধার আইয়ে, কুছ্ শাস্ত্র-চর্চ্চা করেঙ্গে।’ আমার তখন মথুরাপুরী দেখিতে উৎসাহ, আমি তখন তাহাকে কোন উত্তর না দিয়া চলিয়া গেলাম।
(ক্রমশ)