মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ থেকে

পূর্ব প্রকাশিতের পর

এখানেও কাশীর দণ্ডীর ন্যায় লোকদের দেখিয়া আমি আশ্চর্য্য হইলাম। এখানে দণ্ডীরা আইল কোথা হ’তে? তাহার পরে জানিলাম যে, ইহারা ফুঙ্গী, বৌদ্ধদিগের গুরু ও পুরোহিত। আমি আড়ালে থাকিয়া ইহাদের এই বাতির খেলা দেখিতেছি, হঠাৎ তাহাদের এক জন আমাকে দেখিতে পাইয়া তাহাদের ঘরের ভিতর আমাকে লইয়া গেল। বসিতে আসন দিল, এবং পা ধুইবার জল দিল। আমি তাহাদের ঘরে গিয়াছি, তাহারা এইরূপে আমার অতিথি সৎকার করিল। বৌদ্ধদিগের অতিথি সেবা পরম ধর্ম্ম।

প্রাতঃকাল হইল, আমি নৌকাতে ফিরিয়া আসিলাম। সূর্য্য উদয় হইল। মুদেলিয়ারের আর-আর নিমন্ত্রিত ব্যক্তিরা আসিয়া সেখানে যোগ দিলেন। ইহাতে আমরা পঞ্চাশ জন হইলাম। মুদেলিয়ার সেখানে আমাদের সকলকে আহার করাইলেন। তিনি অনেকগুলি হস্তী সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিলেন; আমরা দুই চারি জন করিয়া সেই হস্তী চড়িয়া সেখানকার মহাজঙ্গল দিয়া চলিলাম। এখানে মধ্যে মধ্যে ছোট ছোট পাহাড়, আর ঘন ঘন জঙ্গল। হাতী ভিন্ন এখানে চলিবার আর অন্য উপায় নাই। আমরা বেলা ৩টার সময়ে সেই পর্ব্বতের গুহার সম্মুখে আসিয়া পঁহুছিলাম। আমরা হাতী হইতে নামিয়া এখান হইতে এক কোমর জঙ্গল ভাঙ্গিয়া হাঁটিয়া চলিলাম। সেই পর্ব্বতগুহার মুখ ছোট; আমরা সকলে গুঁড়ি মারিয়া তাহার মধ্যে প্রবেশ করিলাম। দুই পা গুঁড়ি দিয়া তবে সোজা হইয়া দাঁড়াইতে পারিলাম। তাহার ভিতরে ভারি পিছল। পা পিছ যাইতে লাগিল। সেখান হইতে পা টিপিয়া টিপিয়া খানিক দূর গেলাম। ঘোর অন্ধকার, তিন ৩টার সময় বোধ হইতে লাগিল য়েন রাত্রি ৩টা। ভয় হইতে লাগিল যে, যদি সুড়ঙ্গের পথ হারাইয়া ফেলি, তবে আমরা বাহির হইব কি প্রকারে? সমস্ত দিন এই গুহার মধ্যে ঘুরিতে হইবে।


এই ভাবিয়া আমি যেখানেই যাই, সেই সনড়ঙ্গের ক্ষুদ্র আলোকটুকুর দিকে লক্ষ্য রাখিলাম। সেই অন্ধকার গুহার মধ্যে আমরা পঞ্চাশ জন ছড়াইয়া পড়িলাম, এবং দূরে দূরে দাঁড়াইলাম। আমাদের প্রতি জনের হাতে গন্ধক-চূর্ণ। যেখানে যিনি দাঁড়াইলেন, তিনি সেখানকার পর্ব্বতে খুবরীর মধ্যে সেই গন্ধক-চূর্ণ রাখিয়া দিলেন। আমাদের দাঁড়ান ঠিক হইলে কাপ্তান আপনার গন্ধকের গুঁড়া জ্বালাইয়া দিলেন। অমনি আমরা সকলেই দীয়াশালাই দিয়া আপন আপন গন্ধক-চূর্ণ জ্বালাইয়া দিলাম। একেবারে সেই গুহার পঞ্চাশ স্থানে পঞ্চাশটা রংমশালের আলো জ্বলিয়া উঠিল, আমরা গুহার ভিতরটা সব দেখিতে পাইলাম। কি প্রকাণ্ড গুহা। উপরের দিকে তাকাইলাম, আমাদের দৃষ্টি তাহার উচ্চতার সীমা পাইল না। গুহার ভিতরে বৃষ্টির ধারার বেগে স্বাভাবিক বিচিত্র কারুকর্ম্ম দেখিয়া আমরা আশ্চর্য্য হইলাম।

পরে আমরা বাহিরে আসিয়া সেই পর্ব্বতের বনে বন-ভোজন করিলাম, এবং মুলমীনে ফিরিয়া আসিলাম। ফিরিয়া আসিতে আসিতে পথে নানা যন্ত্র-মিশ্রিত একতানের একটা বাদ্য শুনিতে পাইলাম। আমরা সেই শব্দকে লক্ষ্য করিয়া নিকটে গেলাম। দেখিলাম যে, কতকগুলা বর্ম্মা সেখানে অঙ্গ ভঙ্গী করিয়া নৃত্য করিতেছে। সেই আমোদে কাপ্তান সাহেবরাও যোগ দিয়া তদনুরূপ নৃত্য করিতে লাগিলেন। তাঁহারা বড়আমোদ পাইলেন। একটি বর্ম্মার স্ত্রী ঘরের দ্বারে দাঁড়াইয়াছিল। সে সাহেবদের এই বিদ্রূপ দেখিয়া আমোদোন্মত্ত পুরুষদের কাণে কাণে কি বলিয়া গেল, অমনি তাহারা নৃত্য ও বাদ্য ভঙ্গ করিয়া কে কোথায় পলাইল। কাপ্তান সাহেবরা তাহাদের কত অনুনয় বিনয় করিয়া আবার নৃত্য করিতে বলিলেন; তাহারা শুনিল না, কে কোথায় চলিয়া গেল। ব্রহ্মরাজ্যে পুরুষদিগের উপরে স্ত্রীদিগের এত অধিকার।

মুলমীনে ফিরিয়া আসিলাম। একটি উচ্চ পদস্থ সম্ভ্রান্ত বর্ম্মার সহিত সাক্ষাৎ করিতে তাঁহার বাড়ীতে গেলাম। তিনি বিনয়ের সহিদ আমাকে গ্রহণ করিলেন। ফরাসের উপরে তিনি চৌকিতে, আর আমি এক চৌকিতে বসিলাম। সে একটা প্রশস্ত ঘর, তাহার চারি কোণে তাঁহার চারিটি যুবতী কন্যা বসিয়া কি সেলাই করিতেছে।
(ক্রমশ)