• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ থেকে

একটি ক্ষুদ্র কুটীর; তাহাদের মধ্যে গেরুয়া বসন পরা মুণ্ডিতমস্তক কতকগুলি সন্ন্যাসী মোমবাতির আলো লইয়া তাহা একবার এখানে একবার ওখানে রাখিতেছে।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফাইল চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতের পর
সেখান হইতে জাহাজে ফিরিয়া আইলাম, এবং মুলমীনের অভিমুখে চলিলাম। যখন জাহাজ সমুদ্র ছাড়িয়া মুলমীনের নদীতে গেল, তখন গঙ্গাসাগর ছাড়িয়া গঙ্গা নদীতে প্রবেশের ন্যায় আমার বোধ হইল। কিন্তু এ নদীর তেমন কিছুই শোভা নাই; জল পঙ্কিল, কুম্ভীরে পূর্ণ; সে নদীতে কেহ অবগাহন করে না। মুলমীনে আসিয়া জাহাজ নোঙর করিল। এখানে মান্দ্রাজবাসী একজন মুদেলিয়ার আমাকে অভ্যর্থনা করিলেন। তিনি আপনি আসিয়া আমাকে নিজের পরিচয় দিলেন। তিনি একজন গবর্ণমেন্টের উচ্চ কর্ম্মচারী, অতি ভদ্রলোক। তিনি আমাকে তাঁহার বাড়ীতে লইয়া গেলেন। যে কয় দিন আমি মুলমীনে ছিলাম, সেই কয় দিনের জন্য আমি তাঁহারই আতিথ্য স্বীকার করিলাম। আমি অতি সন্তোষে তাঁহার বাড়ীতে এ কয় দিন কাটাইলাম।

মুলমীন নগরের পথ সকল পরিষ্কার ও প্রশস্ত। দু-ধারী দোকানে কেবল স্ত্রীলোকেরাই নানাপ্রকার পণ্যসামগ্রী বিক্রয় করিতেছে। আমি পেটরা ও উৎকৃষ্ট রেশমের বস্ত্রাদি তাহাদের নিকট হইতে ক্রয় করিলাম। বাজার দেখিয়ে দেখিতে একটা মাছের বাজারে প্রবেশ করিলাম। দেখি যে, বড় বড় টেবিলের উপরে বড় বড় মাছ সব বিক্রয়ের জন্য রহিয়াছে। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এ সব অতি বড়-বড় কি মাছ?’ তাহারা বলিল, ‘কুমীর’। বর্ম্মারা কুমীর খায়; অহিংসা-বৌদ্ধধর্ম্ম কেবল ইহাদের মুখে, কিন্তু পেটে কুমীর!

এই মুলমীনের প্রশস্ত রাস্তা দিয়া এক দিন সন্ধ্যার সময়ে বেড়াইতেছি; দেখি, একজন লোক আমার দিকে আসিতেছে। একটু নিকটে আইলে বুঝিলাম, সে বাঙ্গালী। সেখানে তখন বাঙ্গালী দেখিয়া আমি আশ্চর্য্য হইলাম। এই সমুদ্রপারে বাঙ্গালী কোথা হইতে আইল? সে বলিল, ‘আমি একটা বিপদে পড়িয়া আসিয়াছি।’ আমি অমনি সে বিপদ বুঝিতে পারিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কত বৎসরের বিপদ?’ সে বলিল, ‘‘সাত বৎসরের।’’ জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কি করিয়াছিলে?’ সে বলিল, ‘আর কিছু নয়, একটা কোম্পানীর কাগজ জাল করিয়াছিলাম। এখন আমার মেয়াদ ফুরাইয়া গিয়াছে, কিন্তু অর্থাভাবে বাড়ী যাইতে পারিতেছি না।’ আমি তাহাকে পাথেয় দিতে চাহিলাম। কিন্তু সে কোথায় বাড়ী আসিবে। সে সেখানে ব্যবসা বাণিজ্য করিয়াছে, বিবাহ করিয়াছে, এবং সুখে স্বচ্ছন্দে রহিয়াছে। সে কি আর কালা মুখ দেখাইতে দেশে আসিবে!

মুদেলিয়ার আমাকে বলিলেন যে, এখানে একটি দর্শনীয় পর্ব্বতগুহা আছে; অভিপ্রায় হইলে আপনাকে সঙ্গে লইয়া তাহা দেখাইতে পারি। আমি তাহাতে সম্মত হইলাম। তিনি সেই অমাবস্যার রাত্রির জোয়রে একটা লম্বা ডিঙ্গি আনিলেন, তাহার মাঝখানে একটা কাঠের কামরা. সেই রাত্রিতে মুদেলিয়ার এবং আমি, জাহাজের কাপ্তান প্রভৃতি ৭/৮ জনকে লইয়া তাহাতে বসিলাম, এবং রাত্রি দুই প্রহরের সময়ে নৌকা ছাড়িলাম। আমরা সারা রাত্রি সেই নৌকাতে বসিয়া জাগিয়া রহিলাম। সাহেবরা তাঁহাদের ইংরাজী গান গাহিতে লাগিলেন। আমাকে বাঙ্গালা গান গাহিতে অনুরোধ করিলেন। আমি মধ্যে মধ্যে ব্রহ্মসঙ্গীত গাইতে লাগিলাম। তাহারা কেহই তাহার কিছুই বুঝিল না; তাহারা হাসিতে লাগিল; তাহাদের তাহা ভালই লাগিল না; সেই রাত্রিতে ১২ ক্রোশ চলিয়া আমরা আমাদের গম্যস্থানে ভোর ৪টার সময়ে পঁহুছিলাম।

আমাদের নৌকা তীরে লাগিল। এখনো সব অন্ধকার। তীরের অদূরে দেখি যে, একটা তরু ও লতা বেষ্টিত বাড়ী হইতে কতগুলো দীপের আলো বাহির হইতেছে। আমি কৌতূহলবিশিষ্ট হইয়া সেই অজ্ঞাত স্থানে, সেই অন্ধকারে-অন্ধকারে একা দেখিতে গেলাম। গিয়া দেখি, একটি ক্ষুদ্র কুটীর; তাহাদের মধ্যে গেরুয়া বসন পরা মুণ্ডিতমস্তক কতকগুলি সন্ন্যাসী মোমবাতির আলো লইয়া তাহা একবার এখানে একবার ওখানে রাখিতেছে।

(ক্রমশ)