• facebook
  • twitter
Saturday, 28 September, 2024

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ থেকে

পূর্ব প্রকাশিতের পর বোট পিনিসের টানে এক-কেতে হইয়া চলিল; সে দিকটা জলের সঙ্গে প্রায় মিশিয়াই পড়িল, কেবল এক আংগুল মাত্র জল হইতে ছাড়া। মাস্তুলে জড়ান দড়ি কাটিয়া দিবার জন্য একটা গোল পড়িয়া গেল, ‘আন্ দা, আন্ দা’; কিন্তু দা কেহ খুঁজিয়া পায় না। একখানা ভোঁতা দা লইয়া একজন মাস্তুলের উপর উঠিল। আঘাতের পর আঘাত, তার

পূর্ব প্রকাশিতের পর

বোট পিনিসের টানে এক-কেতে হইয়া চলিল; সে দিকটা জলের সঙ্গে প্রায় মিশিয়াই পড়িল, কেবল এক আংগুল মাত্র জল হইতে ছাড়া। মাস্তুলে জড়ান দড়ি কাটিয়া দিবার জন্য একটা গোল পড়িয়া গেল, ‘আন্ দা, আন্ দা’; কিন্তু দা কেহ খুঁজিয়া পায় না। একখানা ভোঁতা দা লইয়া একজন মাস্তুলের উপর উঠিল। আঘাতের পর আঘাত, তার পরে আঘাত, কিন্তু ও ভোঁতা দা-য়ে দড়ি কাটে না। অনেক কষ্টে একটা দড়ি কাটিল, দুইটা কাটিল। তৃতীয়টা কাটিতেছে, আমি আর রাজনারায়ণ বাবু স্তব্ধ হইয়া জলের দিকে তাকাইয়া আছি। এ নিমিষে আছি, পর নিমিষে আর নাই, জীবন ও মৃত্যু পাশাপাশি। রাজনারায়ণ বাবুর চক্ষু স্থির, বাক্য স্তব্ধ, শরীর অসাড়। এদিকে দাঁড়ীরা দড়িই কাটিতেছে। আবার একটা ভারি দম্কা আইল। দাঁড়ীরা বলিয়া উঠিল, ‘আবার তাই রে, তাই!’ বলিতে বলিতে শেষ দড়িটা কাটিয়া ফেলিল। বোট নিষ্কৃতি পাইয়া তীরের ন্যায় ছুটিয়া একেবারে ওপারে চলিয়া গেল এবং পাড়ের সঙ্গে সমান হইয়া দাঁড়াইল। আমি অমনি বোট হইতে ডাঙ্গায় উঠিয়া পড়িলাম; রাজনারায়ণ বাবুকেও ধরাধরি করিয়া তুলিলাম।

এখন ডাঙ্গা পাইয়া আমাদের প্রাণ বাঁচিল, কিন্তু পিনিস তখনও দৌড়াইতেছে। দাঁড়ীরা চেঁচাইতে লাগিল, ‘থামা, থামা’। তখন সূর্য্য অস্ত গেল; মেঘের ছায়ার সঙ্গে সন্ধ্যার ছায়া মিশিয়া একটু ঘোর হইল; পিনিস থামিল কি না, অন্ধকারে ভাল দেখিতে পাইতেছি না। ওদিকে দেখি, একটা ছোট নৌকা বেগে আমাদের বোটের দিকে আসিতেছে। দেখিতে দেখিতে সেই নৌকা আমাদের বোটকে ধরিল। আমি বলিলাম, ‘এ আবার কি? ডাকাদের নৌকা নাকি?’ আমার ভয় হইল। সেই নৌকা হইতে লাফাইয়া একজন পাড়ের উপর উঠিল। দেখি যে, আমার বাড়ীর সেই স্বরূপ খানসামা। তাহার মুখ শুষ্ক। সে আমাকে একখানা চিঠি দিল। সেই অন্ধকারে অনেক চেষ্টা করিয়া যাহা পড়িলাম, তাহাতে বোধ হইল, ইহাতে আমার পিতার মৃত্যু সংবাদ আছে। সে বলিল, ‘কলিকাতা তোলপাড় হইয়া গিয়াছে। আপনার খোঁজে নৌকা করিয়া কত লোক বাহির হইয়াছে, কেহ আপনাকে ধরিতে পারে নাই। আমার এত কষ্ট সার্থক যে আমি আপনাকে ধরিলাম।’

এ সংবাদ হঠাৎ বজ্রপাতের ন্যায় আমার মস্তকে পড়িল। আমি স্তব্ধ ও বিষণ্ণ হইয়া বোট লইয়া পিনিস ধরিতে গেলাম, এবং সেই পিনিস ধরিয়া তাহাতে উঠিলাম। সেখানে আলোতে পত্রখানা স্পষ্ট করিয়া পড়িলাম। এখন আর কি হইবে? তাঁহার মৃত্যু-সংবাদ এখন আর কাহাকেও শুনাইলাম না।

যখন আমরা ইহা দ্বারা বুঝিলাম যে, বেদের মধ্যে দুই বিদ্যা আছে, পরা বিদ্যা এবং অপরা বিদ্যা, তখন অপরা বিদ্যার বিষয় কি, এবং পরা বিদ্যারই বা বিষয় কি, তাহা বিস্তাররূপে জানিবার জন্য বেদের অনুসন্ধানে উৎসুক হইলাম। স্বয়ং কাশী যাইতে প্রস্তুত হইলাম। লালা হাজরীলালকে সঙ্গে লইয়া ১৭৬১ শকের আশ্বিন মাসে পাল্কীর ডাকে কাশী যাত্রা করিলাম। ১৪ দিনে অতি কষ্টে আমরা সেখানে উপস্থিত হইলাম। গঙ্গাতীরে মানমন্দিরে আমার বাসস্থান হইল।

আমার কাশী পহুঁছিবার তৃতীয় দিবসে প্রাতঃকালে মানমন্দিরের প্রশস্ত গৃহ ব্রাহ্মণে ব্রাহ্মণে পূর্ণ হইয়া গেল। তাঁহাদের সকলকে চারি পংক্তিতে বসাইলাম; ঋগ্বিদের এক পংক্তি, যজুর্ব্বেদের দুই পংক্তি, এবং অথর্ব্ববেদের এক পংক্তি। সামবেদূ দুইটি মাত্র বালক; তাহাদিগকে আমার পার্শ্বে বসাইলাম। তাহারা নূতন ব্রহ্মচারী, এখনো তাহাদের কর্ণে কূণ্ডল আছে, তাহাতে তাহাদের মুখের বড় শোভা হইয়াছে। বাণেশ্বর চন্দনের বাটী রইলেন, তারকনাথ ফুলের মালা লইলেন, রমানাথ কাপড়ের থান লইবেন, এবং আনন্দচন্দ্র ৫০০ পাঁচশত টাকা লইলেন। ব্রাহ্মণের ললাটে বাণেশ্বর যেমন চন্দনের ফোঁটা দিলেন, অমনি তারকনাথ তাঁহার গলায় ফুলের মালা দিলেন; রমানাথ ত! পরে তাঁহাকে একখানা থান কাপড় দিলেন; অবশেষে আনন্দচন্দ্র তাঁহার হস্তে দুইটি টাকা দিলেন। এইরূপে প্রত্যেক ব্রাহ্মণকে ফোঁটা, মালা, কাপড় ও মূদ্রা বিতরিত হইল।
(ক্রমশ)