মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ থেকে

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফাইল চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতের পর

(১৮৫৮, নভেম্বর)
আমি তাহার পর দিনে দেখিলাম যে, এলাহাবাদের রাস্তায় গবর্ণমেন্ট পথিকদিগকে এই বিজ্ঞাপন দিয়াছেন যে, ‘যিনি আরো পূর্ব্বাঞ্চলে যাইতে চাহিবেন, গবর্ণমেন্ট তাঁহার জীবনের জন্য দায়ী হইবেন না।’ এই বিজ্ঞাপন দেখিয়া আমার মন বড়ই উৎক্ষিপ্ত হইল। শুনিলাম, তখনো দানাপুরে কুমার সিংহের লড়াই চলিতেছে। মন করিলাম, ডাঙ্গা পথে যাইতে যদি এত বিপদ, জলপথেও কি যাইবার সুবিধা নাই? এই ভাবিতে ভাবিতে আমি গঙ্গার ধারে বেড়াইতে চলিলাম। বেড়াইতে গিয়া দেখি যে, একটি স্টীমারে ধুমা উড়িতেছে, সে তখন ছাড়ে ছাড়ে। আমি দৌড়াদৌড়ি গিয়া তাহাতে উঠিয়া পড়িলাম। কাপ্তানকে জিজ্ঞাসকা করিলাম, ‘স্টীমার কোথায় যাইবে?’ সে বলিল, ‘একটা স্টীমার কিছু দূরে মাঝ-গঙ্গায় চড়ায় ঠেকিয়া রহিয়াছে; তাহাকে উঠাইয়া দিবার জন্য এখন এ স্টীমার যাইতেছে। এখানে ফিরিয়া আসিয়া তিন দিন পরে এ কলিকাতায় যাইবে।’ তখন আমি তাহার একটা ঘর ভাড়া করিবার জন্য আগ্রহ জানাইলাম।

সে বলিল, ‘রুগ্ম ও আহত সৈনিক পুরুষদিগকে কলিকাতায় লইয়া যাইবার জন্য এ স্টীমার গবর্ণমেন্ট ভাড়া করিয়াছেন। পথিকদিগের জন্য ইহার ঘর মিলিবে না। তবে যদি তুমি সৈন্যাধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ারের নিকট হইতে এক হুকুম আনিতে পার, তবে আমি তোমাকে ইহাতে লইতে পারি।’ আমি তাহার এই উপদেশ অনুসারে খুঁজিয়া খুঁজিয়া সেই ব্রিগেডিয়ারের কার্য্যলয়ে, একটা মস্ত বাঙ্গালায়, উপস্থিত হইলাম। তখন ব্রিগেডিয়ার অন্য কাজে বড় ব্যস্ত ছিলেন বলিয়া আমাকে পর দিন সকালে আসিতে বলিলেন। সকালে বলিতে প্রভাতে কিম্বা বেলা দশটার সময় তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইবে, ইহা আমি বুঝিতে না পারিয়া, আমি প্রভাতেই তাঁহার দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইলাম। বসিয়া বসিয়া দশটা বাজিয়া গেল; তখন তিনি তাঁহার অফিসেই আমাকে ডাকিলেন।


আমি তাঁহার নিকট আমার প্রার্থনা জানাইলাম। তিনিও বলিলেন যে, ‘এ ষ্টীমারে সৈনিক পুরুষেরা যাইবে; তাহাদের সহিত তাহাদের স্ত্রী পুত্র পরিবার ভিন্ন ইহাতে আর কেহ স্থান পাইতে পারে না।’ আমি বলিলাম, ‘যখন গবর্ণমেন্ট পথিকদিগকে ডাঙ্গাপথে যাইতে নিষেধ করিতেছেন, এবং জলপথে গবর্ণমেন্টের লোকদের সঙ্গে নিরাপতে যাইবার আমার সুযোগ হইতেছে, তখন তুমি আমাকে যাইতে দিবে না কেন?’ ব্রিগেডিয়ার মনে করিয়াছিলেন যে, আমি বিদ্রোহী দলের কেহ হইব; আমার এইরূপ কথা শুনিয়া তিনি আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলেন। সিমলাতে লর্ড হে প্রভৃতির সঙ্গে আমার আলাপ আছে, জানাইয়া, তাঁহাকে আমার সকল পরিচয় দিলাম। তখন তিনি একটা ক্যাবিন আমাকে ভাড়া দিবার জন্য ষ্টীমারের কাপ্তানকে চিঠী দিলেন।

ইতিমধ্যে সেই ষ্টীমার ফিরিয়া আসিয়াছে, এবং কলিকাতায় যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছে। আমি যাইয়া কাপ্তানকে ব্রিগেডিয়ারের চিঠী দিলাম। কিন্তু এখন কাপ্তান বলিলেন যে, ‘এ চিঠীতে কি হইবে? ষ্টীমারে ক্যাবিন তো খালি নাই, তোমাকে ক্যাবিন কি করিয়া দিব?’ আমি বলিলাম, ‘যদি ক্যাবিন নাই, তো আমি ডেকেই যাইব; তুমি ক্যাবিনের ভাড়া লও, ও আমাকে ষ্টীমারের ডেকে যাইতে দাও!’ ষ্টীমারের সঙ্গে যে কার্গো-বোট ছিল, তাহার কাপ্তান আমাদের এই বিতণ্ডা শুনিয়া সেখানে আইল, এবং বলিল, ‘ষ্টীমারে ক্যাবিন নাই, কিন্তু আমার বোটে আমার যে ক্যাবিন আছে, তাহার ভাড়ারটাকা দিলে আমি তাহা ছাড়িয়া দিব।’ (ক্রমশ)