মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ থেকে

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফাইল চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতের পর

এখান হইতে আম্বালায় আসিয়া ডাকের গাড়ী ভাড়া করিলাম, এবং তাহাতে চড়িয়া দিনরাত্রি চলিতে লাগিলাম। রাত্রি জ্যোৎস্নাময়ী, আকাশে শরতের পূর্ণচন্দ্র ফুটিয়া রহিয়াছে, খোলা মাঠ হইতে শীতল বায়ু আসিতেছে। গাড়ী হইতে বাহিরে মুখ বাড়াইয়া দেখি যে ঘোড়াসওয়ার আমার গাড়ীর পাশে পাশে ছুটিতেছে। বিদ্রোহীদিগের ভয়ে গবর্ণমেন্ট পথিকদিগের নিরাপদের জন্য গাড়ীর সঙ্গে রাত্রিতে সওয়ার ছুটিবার নিয়ম করিয়া দিয়াছেন। আমি ইহাতে পথের সঙ্কট বুঝিতে পারিলাম, এবং আমার মনে মনে কিছু শঙ্কা হইল।

বেলা দুই প্রহরের সময় কানপুরের নিকটবর্ত্তী একটা স্থানে ঘোড়া বদলাইবার জন্য আমার গাড়ী থামিল। দেখি যে, সেখানে একটা মাঠে অনেক তাম্বু পড়িয়াছে, লোকের বিস্তর ভিড় এবং সেখানে একটা বাজার বসিয়াছে। কিছু খাদ্যের জন কিশোরীকে পাঠাইলাম; সে সেখান হইতে আমার জন্য মহিষের দুগ্ধ আনিয়া দিল। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এখানে কিসের বাজার?’ বলিল, ‘দিল্লীর বাদশাকে ধরিয়া লইয়া যাইতেছে, তাহারই জন্য বাজার।’ সিমলাতে যাইবার সময়ে ইহাকে যমুনার চরে সুখে ঘুঁড়ি উড়াইতে দেখিয়াছিলাম; আমি আসিবার সময় ইঁহাকে দেখিলাম যে, ইনি বন্দী হইয়া কারাগারে যাইতেছেন। এই ক্ষণ-ভঙ্গুর দুঃখময় সংসারে কাহার ভাগ্যে কখন কি ঘটে, তাহা কে বলিতে পারে?


সিমলা হইতে বিপদ্সঙ্কুল অতি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করিয়া কানপুরে উপস্থিত হইলাম। এখন এখান হইতে রেল পথ খুলিয়াছে। শুনিলাম, প্রাতে ছয়টার সময়ে গাড়ী ছাড়িবে। আমি ভোরে উঠিয়া একটু চা পান করিয়া তাড়াতাড়ি স্টেশণে পঁহুছিলাম। সাতটা বাজিয়া গেল, কিশোরী স্টেশণ হইতে আসিয়া বলিল যে, ‘টিকিট পাওয়া যাইবে না। আজ গাড়ীতে দিল্লীর ফেরত আঘাতী সৈন্যেরা যাইবে। অন্যের জন্য তাহাতে জায়গা নাই।’ আমি নিজে অনুসন্ধানের জন্য স্টেশণের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। একজন বাঙ্গালী স্টেশণ মাষ্টার আমাকে দেখিতে পাইয়া বলিল, ‘আপনি? ওরে, গাড়ী থামা, থামা। আমি মনে করিয়াছিলাম আর কেউ!’ সে বলিল, ‘আপনাকে আমি টিকিট দিতেছি এবং আমার ক্ষমতা আছে আমি গাড়ী থামাইয়া আনাকে উঠাইয়া দিতে পারিব। আমি আপনার তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার পুরাতন ছাত্র; পরীক্ষায় আমাকে কতবার পুরস্কার দিয়াছেন। আমার নাম দীননাথ।’ সে আমাকে টিকিট দিল; আমি কাপ্তান সাহেবদের সঙ্গে প্রথম শ্রেণীর গাড়ীতে চড়িয়া কানপুর ছাড়িলাম।

বেলা তিনটার সময়ে এলাহাবাদে পঁহুছিলাম। তখন তথাকার স্টেশণ নির্ম্মিত হয় নাই। পথের মধ্যে একটা স্থানে গাড়ীলাগিল, আমার সেখান হইতে নামিয়া হাঁটিয়া চলিলাম। তিন ক্রোশ দূরে এলাহাবাদের ডাক বাঙ্গালা পাইলাম। সেখানকার ঘর সব লোকে পূর্ণ হইয়া গিয়াছে; আমি সে বাঙ্গালায় আর স্থান পাইলাম না। আমার সঙ্গে একটা চৌকী ছিল, একটা বৃক্ষতলায় জিনিস পত্র রাখিয়া সেখানে সেই চৌকীতে আমি বসিলাম। কিশোরী ডাক বাঙ্গালা হইতে আমার জন এক কুঁজা জল আনিল।

আমি কিশোরীকে বলিলাম যে, ‘তুমি এলাহাবাদ সহরে যাইয়া আমার জন্য একটা বাড়ী ঠিক করিয়া আমাকে এখান হইতে লইয়া যাও; বাড়ীতে না উঠিয়া আমি জল গ্রহণ করিব না।’ কিশোরী চলিয়া গেল। পরেই এক খানা গাড়ী আসিয়া উপস্থিত। গলায় কাচা বান্ধা দুই জন লোক তাহা হইতে নামিয়া আমাকে বলিল, ‘কেল্লার নিকটেই আমাদের লালকুঠি; যদি মহাশয় অনুগ্রহ করিয়া সেখানে থাকেন, তবে আমরা বড়ই কৃতার্থ হই। আমাদের এখন পিতৃদায়।’ আমি তাহাদের সঙ্গে সেই লালকুঠিতে গেলাম। তাহাদের ঠাকুর-সেবা ছিল, আমার জন্য সেখান হইতে ডাল আর রুটী সন্ধ্যার সময় আসিল। আমার তখন অত্যন্ত ক্ষুধা হইয়াছে। সে ডাল আর রুটী আমার বড়ই সুস্বাদু লাগিল। আমি তাহা তৃপ্তিপূর্ব্বক সব খাইয়া আরো প্রত্যাশা করিতেছিলাম; কিন্তু কেহই আর আমাকে জিজ্ঞাসা করিল না। আমি সে দিন ঠাকুরবাড়ীর প্রসাদ খাইয়া সেখানে বিশ্রাম করিলাম।

(ক্রমশ)