মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ থেকে

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফাইল চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতের পর

(১৮৫৭-১৮৫৮)
এখন হিমালয়ে বর্ষা ঋতু আারম্ভ হইল, ঈশ্বরের জল-যন্ত্র দিবানিশি চলিতে লাগিল। চিরকাল মেঘ ঊর্দ্ধে দেখিয়া আসিয়াছি; এখন দেখি, অধস্তন পর্ব্বতের পাদমূল হইতে শ্বেত বাষ্পময় মেঘ উঠিতে লাগিল। ইহা দেখিয়া আমি আশ্চর্য্য হইলাম। ক্রমে ক্রমে তাহা পর্ব্বত-শিখর পর্য্যন্ত আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। আমি একেবারে মেঘের মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া ঋষি-কল্পিত ইন্দ্রের রাজত্ব প্রত্যক্ষ করিলাম। খানিক পরেই বৃষ্টি হইয়া মেঘ পরিষ্কার হইয়া গেল। আবার পর্ব্বত হইতে তুলারাশির ন্যায় মেঘ উঠিয়া সকল আচ্ছন্ন করিল। তার পরেই বৃষ্টি হইয়া আবার সূর্য্যের প্রকাশ হইল। এই প্রকারে ঈশ্বরের জল-যন্ত্র দিবা-নিশি কার্য্য করিতে লাগিল। শ্রাবণ মাসের ঘোর বর্ষাতে, হয়তো এক পক্ষ চলিয়া গেল, সূর্য্যের সঙ্গে আর দেখা হইল না। তখন মেঘে সকল এমনি আবৃত, যেন দশ হাত দূরে আর সৃষ্টি নাই। আমি আছি, আর আমার সঙ্গে কেবল ঈশ্বর আছেন। তখন সহজেই আমার মন সংসার হইতে উপরত হইল, তখন সহজেই আমার আত্মা সমাহিত হইয়া পরমাত্মাতে বিশ্রাম করিল। ভাদ্র মাসে হিমালয়ের জটাজুটের মধ্যে জল-কল্লোলের বিষম কোলাহল, তাহার প্রস্রবণ সকল পরিপুষ্ট, নির্ঝর সকল প্রমুক্ত, পথ সকল দুর্গম।
এখানে আশ্বিন মাসে শরৎকালের তেমন কিছুই বিকাশ নাই। কার্ত্তিক মাস হইতেই শীতল বায়ু অনাবৃত শরীরকে শীতার্ত্ত করিতে লাগিল। অগ্রহায়ণ মাসের অর্দ্ধেক যাইতে না যাইতেই এক প্রাতঃকালে নিদ্রা ভঙ্গের পর বাহিরে আসিয়া উৎফুল্ল নেত্রে দেখি যে, পর্ব্বত তল হইতে শিখর পর্য্যন্ত বরফে আবৃত হইয়া সকলি শ্বেত। গিরিরাজ শুভ্র রজত বসন পরিধান করিয়াছেন। বরফে শীতল বায়ুর নিঃশ্বাস আমি এই প্রথম উপভোগ করিলাম।

দিন যত যাইতে লাগিল, শীত ততই বাড়িতে লাগিল। এক দিন দেখি যে, কৃষ্ণবর্ণ মেঘ হইতে ধূনিত লঘু তুলার ন্যায় বরফ পড়িতেছে। জমাট বরফ দেখিয়া মনে ছিল যে, বরফ প্রস্তরের ন্যায় ভারি এবং কঠিন; এখন দেখি যে, তাহা তুলার ন্যায় পাতলা ও হালকা। বস্ত্র ঝাড়িয়া ফেলিলেই বরফ পড়িয়া যায় এবং যেমন শুষ্ক তেমনি শুষ্কই থাকে।


পৌষ মাসের একদিন প্রাতঃকালে উঠিয়া দেখি যে, দুই তিন হাত বরফ পড়িয়া সকল পথ রুদ্ধ করিয়া ফেলিয়াছে। মজুরেরা আসিয়া সেই বরফ কাটিয়া পথ মুক্ত করিয়া দিলে তবে লোক যাতায়াত করিতে লাগিল। আমি কৌতূহলে আবিষ্ট হইয়া সেই বরফের পথেই চলিলাম। প্রাতে আর বেড়ান বন্ধ হইল না। স্ফূর্ত্তি ও আনন্দে আমি এত দূর এত বেগে চলিয়া গেলাম যে, সেই শীতকালে বরফের মধ্যে আমি গ্রীষ্ম অনুভব করিলাম, এবং ভিতরের বস্ত্র ঘর্ম্মে আদ্র হইয়া গেল। তখনকার আমার শরীরের বল ও সুস্থতার এই পরিচয়।

প্রতি দিন প্রাতঃকালেই আমি এইরূপ আনন্দে বহুদূর ভ্রমণ করিয়া আসিতাম, এবং পরে চা ও দুগ্ধ পান করিতাম। দুই প্রহরের সময়ে স্নানে বসিয়া বরফ মিশ্রিত জল আপনাপনি মস্তকে ঢালিয়া দিতাম। নিমেষের জন্য আমার হৃদয়ের শোমিত চলা বন্ধ হইত, এবং পরক্ষণেই তাহা দ্বিগুণ বেগে চলিয়া আমার শরীরে সমধিক স্ফূর্ত্তি ও তেজের সঞ্চার করিত।
পৌষ মাঘ মাসের শীতেতেও আমি গৃহে আগুন জ্বালাইয়া দিতাম না। শীত কতদূর শরীরে সহ্য হয়, তাহা পরীক্ষা করিবার জন্য, এবং তিতিক্ষা ও সহিষ্ণুতা অভ্যাস করিবার জন্য আমি এইরূপ নিয়ম অবলম্বন করিয়াছিলাম। রাত্রিতে আমি আমার শয়ন ঘরের দরজা খুলিয়া রাখিতাম; রাত্রির সেই শীতের বাতাস আমার বড়ই ভাল লাগিত।
(ক্রমশ)