মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ থেকে

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফাইল চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতের পর

আজ সব ডাক জ্বালাইয়া দিয়াছে।’ তাহার পর দিন জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘ঘোষজা, আজিকার কি খবর?’ বলিলেন, ‘আজিকার বড় ভাল খবর নয়। আজ জলন্ধর হইতে বিদ্রোহীরা আসিতেছে।’ ঘোষজার নিকট হইতে এক দিনও ভাল খবর পাওয়া যায় না। তিনি প্রতি দিনই মুখ ভার করিয়া আসেন। আমি এইরূপে অতি কষ্টে এগারো দিন অতিবাহিত করিলাম।

এখন সংবাদ আইল যে, সিমলা নির্ব্বিঘ্ন হইয়াছে, আর কোন ভয় নাই। আমি সিমলা যাইবার জন্য উদ্যোগ করিলাম। কুলি আনিতে পাঠাইলাম; শুনিলাম কুলি নাই, ওলাওঠার ভয়ে তাহারা পলাইয়াছে। একটা ঘোড়া পাইলাম। সেই ঘোড়াতে বৈকালে সওয়ার হইয়া চলিলাম। খানিক দূর আসিয়া রাত্রিতে একটা আড্ডায় থাকিলাম। তাহার পর দিন প্রাতঃকালে আমি আবার সেই ঘোড়ায় চড়িয়া আসিতে লাগিলাম। কিশোরীকে আর আমার সঙ্গে পাইলাম না। সেই আবরণহীন পর্ব্বতে তখন জ্যৈষ্ঠ মাসের রৌদ্রের উত্তাপ বড়ই প্রখর হইয়াছে। একটু ছায়ার জন্য আমি লালায়িত হইলাম, কিন্তু একটি বৃক্ষ নাই যে, আমাকে একটু ছায়া দেয়। পিপাসায় কণ্ঠ শুকাইয়া গিয়াছে, সঙ্গে আর একটি মানুষ নাই যে, একবার ঘোড়াটা ধরে। আমি সেই অবস্থায় মধ্যাহ্ন পর্য্যন্ত চলিয়া একটা বাঙ্গালা পাইলাম। ঘোড়াটিকে এক স্থানে বাঁধিয়া তথায় বিশ্রাম করিতে গেলাম। একটু জল চাহিতেছি, দৈবক্রমে পলায়িতা একটি বিবি সেখানে ছিলেন, তিনি সমদুঃখে দুঃখী হইয়া আমার জন্য একটু মাখন ও তপ্ত আলু আর একটু জল পাঠাইয়া দিলেন। আমি তাহা খাইয়া ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ করিয়া প্রাণ ধারণ করিলাম। সন্ধ্যার সময়ে সিমলাতে পঁহুছিলাম। দরজায় দাঁড়াইয়া ডাকিতেছি, ‘কিশোরী, আছ এখানে? এখানে কি আছ?’ দেখি যে, কিশোরী আসিয়া দরজা খুলিয়া দিল। আমি ডগশাহী হইতে ১৮ই জ্যৈষ্ঠ দিবসে সিমলায় ফিরিয়া আইলাম।


(১৮৫৭, জুন) আমি সিমলাতে ফিরিয় আসিয়া কিশোরী নাথ চাটুয্যেকে বলিলাম, ‘আমি সপ্তাহের মধ্যে আারো উত্তর দিকে উচ্চ উচ্চ পর্ব্বত ভ্রমণে যাইব। আমার সঙ্গে তোমাকে যাইতে হইবে। আমার জন্য একটা ঝাঁপান ও তোমার জন্য একটা ঘোড়া ঠিক করিয়া রাখ।’ ‘যে আজ্ঞা’, বলিয়া তাহার উদ্যোগে সে চলিল। ২৫শে জ্যৈষ্ঠ দিবস সিমলা হইতে যাত্রা করিবার দিন স্থির ছিল। আমি সে দিবস অতি প্রত্যুষে উঠিয়া যাইবার জন্য প্রস্তুত হইলাম। আমার ঝাঁপান আসিয়া উপস্থিত, বাঙ্গীবর্দ্দারেরা সব হাজির। আমি কিশোরীকে বলিলাম, ‘তোমার ঘোড়া কোথায়?‘ ‘এই এলো বো’লে, এই এলো বো’লে’, বলিয়া সে ব্যস্ত হইয়া পথের দিকে তাকাইতে লাগিল। এক ঘণ্টা চলিয়া গেল, তবু তাহার ঘোড়ার কোনো খবর নাই। আমি যাইবার এই বাধা ও বিলম্ব আর সহ্য হইল না, আমি বুঝিলাম যে, অধিক শীতের ভয়ে আরো উত্তরে কিশোরী আমার সঙ্গে যাইতে অনিচ্ছুক। আমি তাহাকে বলিলাম, ‘তুমি মনে করিতেছ যে, তুমি আমার সঙ্গে না গেলে আমি একাকী ভ্রমণে যাইতে পারিব না। আমি তোমাকে চাই না, তুমি এখানে থাক। তোমার নিকট পেটরার ও বাক্সর যে সকল চাবি আছে, তাহা আমাকে দাও।’ আমি তাহার নিকট হইতে সেই সকল চাবি লইয়া ঝাঁপানে বসিলাম। বলিলাম, ‘ঝাঁপান উঠাও।’ ঝাঁপান উঠিল, বাঙ্গীবর্দ্দারেরা বাঙ্গী লইয়া চলিল, হতবুদ্ধি কিশোরী স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

আমি আনন্দে, উৎসাহে, বাজার দেখিতে দেখিতে সিমলা ছাড়াইলাম। দুই ঘণ্টা চলিয়া একটা পর্ব্বতে যাইয়া দেখি, তাহার পার্শ্ব-পর্ব্বতে যাইবার সেতু ভগ্ন হইয়া গিয়াছে, আর চলিবার পথ নাই। ঝাঁপানীরা ঝাঁপান রাখিল। আমার কি তবে এখান হইতে ফিরিয়া যাইতে হইবে? ঝাঁপানীরা বলিল, ‘যদি এই ভাঙ্গা পুলের কার্নিশ দিয়া একা একা চলিয়া এই পুল পার হইতে পারেন, তবে আমার খালি ঝাঁপান লইয়া খাদ দিয়া ওপারে যাইয়া আপনাকে ধরিতে পারি।’ আমার তখন যেমন মনের বেগ, তেমনি আমি সাহস করিয়া এই উপায়ই অবলম্বন করিলাম। কার্নিশের উপরে একটি মাত্র পা রাখিবার স্থান, হাতে ধরিবার কোন দিকে কোন অবলম্বন নাই, নীচে ভয়ানক গভীর খাদ। ঈশ্বর-প্রসাদে আমি তাহা নির্ব্বিঘ্নে লঙ্ঘন করিলাম। ঈশ্বর-প্রসাদে যথার্থই ‘পঙ্গুর্লঙ্ঘয়তে গিরিং।’ আমার ভ্রমণের সঙ্কল্প ব্যর্থ হইল না। তথা হইতে ক্রমে পর্ব্বতের উপরে উঠিতে লাগিলাম। সেই পর্ব্বত একেবারে প্রাচীরের ন্যায় সোজা হইয়া এত উচ্চে উঠিয়াছে যে, সেখান হইতে নীচের খদেরর কেলু গাছকেও ক্ষুদ্র চারার মত বোধ হইতে লাগিল।
(ক্রমশ)