• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ থেকে

জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এমন সঙ্কট সময়ে তুমি এখান হইতে কোথায় গিয়াছিলে?‘ বলিল যে, ‘একটা দরজি আমার কাপড় সেলাইয়ের দর চারি আনা অধিক চায় বলিয়া তাহা চুকাইতে এত বিলম্ব হইয়া গেল।’

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফাইল চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতের পর

তিনি আমাদের প্রতি ভার দিলে আমরা তাহাদিগকে তাড়াইয়া দিতে পারিতাম।’ আমাকে একজন বাঙ্গালী আসিয়া বলিল, ‘মহাশয়! গুর্খারা যদিও সব অধিকার পাইয়াছে, কিন্তু এখনো তাহাদের রাগ পড়ে নাই। তাহারা ইংরাজদিগকে বড়ই গালি দিতেছে।’ আমি বলিলাম, ‘উহাদের রক্ষক নাই,— কাপ্তান-হীন সেনা; এখন বকুক, আবার সব শান্ত হইয়া যাইবে।’

কিন্তু সাহেবরা একেবারে ভয়ে অভিভূত হইয়া পড়িয়াছেন। তাঁহারা নিরাশ হইয়া স্থির নিশ্চয় করিলেন যে, গুর্খারা যখন সিমলা অধিকার করিয়াছে, তখন পলায়ন ব্যতীত প্রাণ রক্ষার আর কোন উপায় নাই। প্রাণ বাঁচাইবার জন্য তাঁহারা সিমলা হইতে পলাইতে আরম্ভ করিলেন। দুই প্রহরের সময় দেখি যে, দণ্ডি নাই, ঝাঁপান নাই, ঘোড়া নাই, সহায় নাই, এমন অনেক বিবি খদ দিয়া ভয়ে দৌড়িতেছে। কে বা কাহাকে দেখে, কে বা কাহার তত্ত্ব লয়? সকলে আপনার আপনারই প্রাণ লয়িা ব্যস্ত। সিমলা একেবারে সন্ধ্যার মধ্যে লোকশূন্য হইয়া পড়িল। যে সিমলা মনুষ্যের কোলাহলে পূর্ণ ছিল, তাহা আজ নিঃশব্দ নিস্তব্ধ। কেবল কাকের কা কা ধ্বনি সিমলার বিশাল আকাশকে পূর্ণ করিতেছে!

সিমলা যখন একেবারে মানবশূন্য হইল, তখন অগত্যা আমাকে আজ সিমলা ছাড়িতে হইবে। যদিও গুর্খারা কোন অত্যাচার না করে, তথাপি খদ হইতে উঠিয়া পাহাড়ীরা সব লুঠ করিয়া লইতে পারে। তবে আজ বেহারা কোথায় পাওয়া যায়! সওয়ারী না পাইলেও সিমলা হইতে যে হাঁটিয়া পলাইিতে হইবে, আমার এত ভয় হয় নাই। এই সময়ে একটা রক্ত-চক্ষু দীর্ঘ কৃষ্ণ পুরুষ আসিয়া আমাকে বলিল, ‘কুলিকা দরকার হ্যায়? কুলি চাহিয়ে?’ আমি বলিলাম, ‘হাঁ, চাহিয়ে।’ বলিল, ‘কয় ঠৌ?’ বলিলাম, বিশঠৌ কুলি চাহিয়ে।’ ‘আচ্ছা, হম লাকে দেগা, হমকো বক্সিষ দেনে হোকা,’ এই বলিয়া যে চলিয়া গেল। ইত্যবসরে সওয়ারার জন্য আমি একটা দোলা সংগ্রহ করিয়া রাখিলাম।

আমি রাত্রিতে আহার করিয়া উদ্বিগ্নচিত্তে শয়ন করিলাম। রাত্রি দুই প্রহর হইয়াছে, তখন, ‘দরজা খোলো, দরজা খোলো’ শব্দের সহিত দুয়ারে ধাক্কা পড়িতে লাগিল। বড়ই কোলাহল হইতে লাগিল। আমার হৃদয় কাঁপিয়া উঠিল, অত্যন্ত ভয় হইল,— বুঝি এইবার গুর্খাদের হস্তে মারা পড়িলাম। আমি ভয়ে ভয়ে দুয়ারটা খুলিয়া দিলাম। দেখি যে, দীর্ঘাকার কৃষ্ণবর্ণ লোকটা বিশ জন কুলি লইয়া ডাকাডাকি করিতেছে। আমি প্রাণের ত্রাস হইতে রক্ষা পাইলাম। তাহারাই আমার রক্ষক হইয়া ঘরের মধ্যে সমস্ত রাত্রি শুইয়া রহিল। আমার প্রতি ঈশ্বরের যে করুণা, তাহা একেবারে প্রকাশ হইয়া পড়িল।

প্রভাত হইল, আমি সিমলা ছাড়িবার জন্য প্রস্তুত হইলাম। কুলিরা বলিল যে, অগ্রে টাকা না পাইলে তাহারা যাইবে না। আমি টাকা দিবার জন্য ‘কিশোরী, কিশোরী’ করিয়া ডাকিতে লাগিলাম। কিন্তু কোথায় কিশোরী? তাহার কাছে খরচের টাকা ছিল, আর আমার কাছে একটা বাক্সভরা এক বাক্স টাকা ছিল। ভাবিয়াছিলাম, এত টাকা কুলিদিগকে দেখাইব না। কিন্তু কিশোরী নাই, কুলিরাও টাকা ব্যতীত উঠে না। আমি তখন তাহাদিগের সম্মুখে সেই বাক্স খুলিয়া প্রতি জনকে তিনটা করিয়া টাকা দিলাম, সেই সর্দ্দারটাকে পাঁচ টাকা পুরস্কার দিলাম; এমন সময়ে কিশোরী উপস্থিত। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এমন সঙ্কট সময়ে তুমি এখান হইতে কোথায় গিয়াছিলে?‘ বলিল যে, ‘একটা দরজি আমার কাপড় সেলাইয়ের দর চারি আনা অধিক চায় বলিয়া তাহা চুকাইতে এত বিলম্ব হইয়া গেল।’

(ক্রমশ)