মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ থেকে

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফাইল চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতের পর

আমি বলিলাম যে, ‘আচ্ছা, আমি টাকা দিতেছি, তুমি তোমার ক্যাবিন আমাকে ছাড়িয়া দাও।’ সে বলিল, ‘তুমি তোমার জিনিসপত্র লইয়া আইস, আমি ইতিমধ্যে তোমার জন্য ক্যাবিন পরিষ্কার করিয়া রাখিতেছি।’ তখন আমি তাহার কথাতে আহ্লাদিত হইয়া দৌড়াদৌড়ি লালকুঠিতে গিয়া আমার সকল দ্রব্যাদি আনিলাম। আমার চির-সুহৃৎ নীলকমল মিত্র আমার পথের খাওয়ার জন্য এক ঝুড়ি মিঠাই সন্দেশ দিলেন; তাহাতে আমার বড়ই উপকার হইয়াছিল।

শীঘ্রই ষ্টীমার কলিকাতাভিমুখে ছাড়িয়া দিল। কিন্তু কাশীতে পঁহুছিয়াই একটা বিঘ্ন উপস্থিত হইল। কাপ্তান এক টেলিগ্রাফ পাইলেন যে, এ কার্গো-বোটের জন্য দ্বিতীয় ষ্টীমার আসিতেছে, তাহাকে অন্য কার্গো-বোট আনিতে ফিরিয়া যাইতে হইবে। কাপ্তান এই টেলিগ্রাফ পাইয়া অস্থির হইল। সে বলিতে লাগিল, ‘আমি আর গবর্ণমেন্টের চাকরী করিব না, গবর্ণমেন্টের হুকুমর কিছুই ঠিকানা নাই। এতটা পথ আসিয়া আবার আমাকে ফিরিয়া যাইতে হইবে, এ বড় অন্যায়।’ কাপ্তানের বাড়ী যাইবার জন্য মনে ব্যগ্রতা ছিল, এদিকে ষ্টীমার কার্গো-বোটকে ছাড়িয়া দিয়া চলিয়া গেলে ষ্টীমারের সাহেব বিবিদিগেরও ফিরিয়া যাইতে হইবে; অতএব সকলে মিলিয়া পরামর্শ করিয়া-স্থির করিলেন যে, ‘এ টেলিগ্রাফে কিছু এমন বলিতেছে না যে, এই খানেই কার্গো-বোট রাখিয়া ষ্টীমার চলিয়া যাইবে। যেখানে আগন্তুক ষ্টীমারের সহিত তাহার দেখা হইবে, সেইখানে তাহাকে কার্গো-বোট দিয়া ফিরিয়া যাইতে হইবে। হয়তো তাহার সঙ্গে দেখা হইবার পূর্ব্বেই এ ষ্টীমার কলিকাতায় পঁহুছিতে পারে।’ সাহেবদিগের এইরূপ পরামর্শে কাপ্তান সম্মত হইয়া ষ্টীমার কলিকাতার দিকে ছাড়িলেন।


আমি এই ষ্টীমারে যাইতে পথে এক সংবাদ পত্রে আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা নগেন্দ্রনাথের মৃত্যু-সংবাদ পাইলাম। এই সংবাদে শোকাবিষ্ট হৃদয়ে অন্যমনস্ক হইয়া একটি কি দ্রব্য আনিবার জন্য ডেক হইতে ক্যাবিনে প্রবেশ করিলাম, এবং সেই দ্রব্য লইয়া তাড়াতাড়ি যেই ক্যাবিনের বাহিরে আসিয়া পা বাড়াইয়াছি, আমার পা আর প্রতিষ্ঠা-ভূমি পাইল না। আমি আচম্বিতে দ্বিতীয় পা না বাড়াইয়া পৃষ্ঠের দিকে একটা ঝোঁক দিয়া ক্যাবিনের মধ্যে পড়িয়া গেলাম। খালাসীরা হাঁ হাঁ করিয়া দৌড়িয়া আসিয়া দেখে যে, আমার এক পা খোলের মধ্যে ঝুলিতেছে, ও আমার সমস্ত শরীরটা ক্যাবিনের মধ্যে পড়িয়া রহিরাছে। তাহারা বলিল, ‘জিনিসতুলিবার জন্য এই ক্যাবিনের সম্মুখের রাস্তার পাটাসকল উঠাইয়া ফেলিয়াছিলাম, আপনি কি তাহা দেখেন নাই?’ আমি তো তাহা দেখি নাই; আমি জানি যে, পূর্ব্বের মত সে রাস্তা ঠিকই আছে। আমি যদি দ্বিতীয় পা বাড়াইতাম, তবে পঞ্চাশ হাত নীচে খোলের মধ্যে পড়িয়া আমার মস্তক চূর্ণ হইয়া যাইত। সে দিনকার জন্য তো আমার প্রাণ বাঁচিল। কিন্তু, ‘সংসারের ডাকাত ঘুমায় নাই, তাহা হইতে নির্ভয় হইও না; যদি আজ সে না নিয়া যায়, কা’ল সে নিয়া যাবে,’—

রামপুর-বোয়ালিয়াতে পঁহুছিতে দেখি যে, ধুমা উড়াইতে উড়াইতে একটা ষ্টীমার আসিতেছে। তাহা দেখিয়া কাপ্তান আমাদের ষ্টীমার থামাইলেন। আগন্তুক ষ্টীমার তাহার কাছ আসিয়া থামিল, এবং সেইখানেই দুই ষ্টীমার নোঙ্গর ফেলাইয়া রহিল। সাহেব বিবিরা এ ষ্টীমারে যাইয়া দেখিলেন যে, সে ষ্টীমারখানি ছোট, এবং তাহার ঘর সংখ্যায় অতি অল্প, ইহাতে তাঁহাদের সকলের সম্পোষ্য হইবে না। সাহেবরা ডেকে থাকিয়াও একপ্রকার কাটাইতে পারেন, কিন্তু বিবিরা কোথা থাকিবেন? কার্গো-বোটে মিলিটারী সার্জন প্রভৃতি যে সকল সাহেবেরা ছিলেন, কাপ্তান তাঁহাদের কাছে যাইয়া তাঁহাদের ক্যাবিন ছাড়িয়া দিতে অনুরোধ করিলেন। মিলিটারী সার্জন কিছু স্পষ্টবাদী; তিনি বলিলেন, ‘এমন কতবার আমি বিবিদের সন্তোষার্থে ক্যাবিন ছাড়িয়া দিয়াছি, কিন্তু তাহার জন্য একটা ‘থ্যাঙ্কও’ পাই নাই।’ কার্গো-বোটের ক্যাবিনের অধিকারী সাহেবেরা কেহই বিবিদের জন্য তাঁহাদের ক্যাবিন ছাড়িতে সম্মত হইলেন না। অবশেষে কাপ্তান আমার কাছে আসিয়া নম্রভাবে অনুরোধ করিলেন, ‘বিবিদের থাকিবার আর স্থানের সঙ্কুলান হইতেছে না, আপনি যদি অনুগ্রহ করিয়া আপনার ক্যাবিনটা ছাড়িয়া দেন, তবে তাঁহারা বড় বাধ্য হন।’

আমি অতি আহ্লাদের সহিত আমার ক্যাবিন তাহাদের জন্য ছাড়িয়া দিলাম। কাপ্তান ইহাতে বড় সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, ‘ইংরাজেরা বিবিদের স্বদেশীয় হইয়াও তাঁহাদের একটু স্থান দিলেন না; আপনি কেমন উদার ভাবে তাঁহাদের জন্য আপনার ক্যাবিন ছাড়িয়া দিলেন; ইহাতে আমরা সকলেই আপনার নিকট কৃতজ্ঞ হইলাম।’ ক্যাবিন ছাড়াতে আমার নিজের কিছু কষ্ট হইল না। যাহাতে আমি ডেকে আরামে থাকি, তাহার জন্য কাপ্তানেরা সকলে মিলিয়া সুন্দর বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন। আমি সেই ডেকের মুক্ত বায়ুতে রাত্রিতে সুখে শয়ন করিলাম। রামপুরে ষ্টীমার বদল ও বন্দোবস্ত করিতে কিছু বিলম্ব হইবে, অতএব আমার আসিবার সংবাদ দিবার জন্য আমি কিশোরীকে একটা ডিঙ্গি করিয়া অগ্রেই বাড়ী পাঠাইয়া দিলাম। তাহার পর দিনই ১৭৮০ শকের ১লা অগ্রহায়ন আমি নির্ব্বিঘ্নে কলিকাতায় উপস্থিত হইলাম। তখন আমার বয়স ৪১ বৎসর।
কত যে তোমার করুণা, ভুলিব না জীবনে নিশি দিন রাখিব গাঁথি হৃদয়ে, কত যে তোমার করুণা!
ওঁ নমস্তেহস্তু ব্রহ্মণ! নমস্তেহস্তু।

(ক্রমশ)