মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ থেকে

আমি একখানা শিলাতলে বসিয়া এই জল-ক্রীড়া দেখিতে লাগিলাম। যেমন এই জলপ্রপাতের অতি শীতল কণা সকল খদে নামিবার পরিশ্রমে আমার ঘর্ম্মাক্ত শরীর স্পর্শ করিতে লাগিল, অমনি আমার চক্ষে অন্ধকার ঠেকিল। আমি ধীরে ধীরে সেই শিলাতলে অচেতন হইয়া শুইয়া পড়িলাম। ক্ষণেক পরে আমার চৈতন্য হইল, আমি চক্ষু মেলিলাম। দেখি যে, আমার সঙ্গী প্যারীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ একেবারে শুষ্ক; তিনি বিষণ্ণ মনে কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া আমার মুখের দিকে তাকাইয়া রহিয়াছেন। আমি অমনি আমার ও তাঁহার অবস্থা স্মরণ করিলাম এবং তাঁহাকে সাহস দিবার জন্য হাসিয়া উঠিলাম, আমি এইরূপে জল-প্রপাত দেখিয়া বাসায় ফিরিয়া আইলাম।
তাহার পরের রবিবারে আবার আমরা কয়েক জন সেই জল-প্রপাতের ধারে বন-ভোজন করিবার জন্য গেলাম। আমি গিয়া সেই জল-প্রপাতের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। আমার মস্তকে তিন শত হস্ত উচ্চ হইতে সেই জল-ধারা পড়িতে লাগিল। পাঁচ মিনিট সেখানে দাঁড়াইয়া রহিলাম। সে হিম জল-কণা সকল আমার প্রতি লোম-কূপ ভেদ করিয়া শরীরের মধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিল। আমি বাহিরে আইলাম। কিন্তু এ বড় আমার আমোদ হইল; আমি আবার তাহার মধ্যে প্রবেশ করিলাম। এইরূপে জল-প্রপাতের ধারার মধ্যে আমার স্নান হইল। আমরা সেই পর্ব্বতের বনে কত আনন্দে বন-ভোজন করিয়া সন্ধ্যার সময়ে বাসাতে ফিরিয়া আইলাম। আমার বাম চক্ষুতে একটু পীড়া ছিল, পর দিন প্রাতে দেখি তাহা আরক্ত বর্ণ হইয়া ফুলিয়া উঠিয়াছে। উপবাস করিয়া চক্ষুরোগ আরাম করিলাম।
৩রা জ্যৈষ্ঠ সেই রোগ-শান্তির পর সুস্থতার হিল্লোলে আমার শরীর মন বড়ই প্রসন্ন হইল। আমি মুক্তদ্বার গৃহের মধ্যে বেড়াইতে চিন্তা করিতেছি যে, এই সিমলার গৃহে আমি চিরজীবন সুখে কাটাইতে পারি। এমন সময়ে আমার ঘরের নীচে দেখি যে, রাস্তা দিয়া কতকগুলা লোক দৌড়িয়া যাইতেছে। আমি তাহা দেখিয়া তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, ‘কি হইয়াছে? এত দৌড়িতেছ কেন?’ উত্তর না দিয়া তাহার মধ্যে এক জন আমাকে হাত নাড়িয়া বলল, ‘পলাও, পলাও!’ জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কেন পলাইব?’ কিন্তু কে কার উত্তর দেয়, সকলেই আপন প্রাণ লইয়া ব্যস্ত! আমি ইহার কিছুই ভাব বুঝিতে না পারিয়া, প্যারী বাবুর নিকট তথ্য জানিতে চলিলাম। গিয়া দেখি, তিনি দেওয়ালের চুণ লইয়া কপালে দীর্ঘ ফোঁটা করিয়াছেন। গলা হইতে উপবীত বাহির করিয়া চাপকানের উপর পরিয়াছেন। চক্ষু রক্তবর্ণ, মুখ মলিন। আমাকে দেখিয়াই বলিলেন, ‘গুর্খারা বামুন মানে।’ জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘হয়েছে কি?’ তিনি বলিলেন , ‘গুর্খা সৈন্যেরা সিমলা লুঠ করিবার জন্য আসিতেছে। আমি স্থির করিয়াছি যে, আমি খদে যাইব।’ আমি বলিলাম যে, ‘তবে আমিও তোমার সঙ্গে যাইব!’ এই কথায় তাঁহার মুখ আরও শুকাইল। তাঁহার ইচ্ছা যে, তিনি একাকী খদে পলাইয়া থাকেন। দুই জন একত্রে গেলে পাহাড়ীদের লোভ বাড়িবে, তাতে বাঁচা ভার হইবে। আমি তাঁহার ভাব বুঝিয়া বলিলাম, ’না, আমি খদে যাইব না।’ আমি বাসায় ফিরিলাম. আসিয়া দেখি যে, আমাদের বাসার তালা বন্ধ। আমি ঘরে প্রবেশ করিতে না পারিয়া রাস্তায় বেড়াইত লাগিলাম। একটু পরেই কিশোরী আসিয়া বলিল যে, ‘টাকার থোলেটা আমি উনেনর ধারে মাটিতে পুঁতিয়া তাহার উপর কাঠ চাপাইয়া রাখিয়াছি, আর গুর্খা চাকরটাকে ঘরের মধ্যে পুরিয়া চাবি দিয়াছি; গুর্খারা গুর্খা দেখিলে কিছু বলিবে না।’ আমি বলিলাম, ‘তাহা তো হইল; তোমার নিজের প্রাণের জন্য কি করিতেছ?’ সে বলিল, ‘রাস্তার ধারে যে এই নর্দ্দমাটা আছে, গুর্খারা আসিলে তাহার মধ্যে আমি প্রবেশ করিয়া থাকিব; আমাকে কেউ দেখিতে পাইবে না।’ গুর্খারা বাস্তবিক আসিতেছে কি না, একটা উচ্চস্থানে উঠিয়া তাহা আমি দেখিতে গেলাম। সেখানে গিয়া কিছুই দেখিতে পাইলাম না। একটা বিজ্ঞাপন দেওয়া ছিল, ‘যদি গুর্খারা সিমলা আক্রমণ করিতে আসে, তবে সকলকে জানাইবার জন্য তোপ পড়িবে।’ দেখি যে, খানিক পরে ভয়ানক তোপও পড়িল। তখন আমি ঈশ্বরের প্রতি নির্ভর করিয়া রাস্তায় বেড়াইতে লাগিলাম। রাত্রি হইল; কোন উপদ্রবই নাই। আমি গৃহে গিয়া নিরাপদে শয়ন করিলাম।প্রভাতে নিদ্রা ভঙ্গ হইলে দেখি যে, আমি বাঁচিয়া আছি, গুর্খারা আক্রমণ করে নাই। বাহিরে গিয়া দেখি যে, গবর্ণমেন্ট-ট্রেজারী প্রভৃতি সকল কার্য্যালয়ে এবং রাস্তায় বন্দুকধারী গুর্খার পাহারা।
(ক্রমশ)