‘হ্যাপি ক্রিসমাস’ থেকে ‘মেরি ক্রিসমাস’

প্রতীকী চিত্র

হীরক কর

আর কয়েক ঘন্টা পরেই ‘সান্তা ক্লজ’ আসবেন। উপহারের প্রত্যাশার গোটা দুনিয়া। আর কলকাতার সব ভিড় এই মুহূর্তে পার্কস্ট্রিটমুখী। ইতিমধ্যেই উৎসবের আনুষ্ঠানিক সূচনা করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আলোয় ঝলমল করে উঠেছে শহরের অন্যতম এই প্রাণকেন্দ্র।

যীশু খ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষে ২৫ ডিসেম্বরকে খ্রিস্টানরা ‘বড়দিন’ হিসেবে পালন করেন। যদিও এই দিনটি যিশুখ্রিস্টের প্রকৃত জন্মদিন কিনা সে সম্পর্কে জানা যায়নি। এমনকি বাইবেল কোথাও যিশুখ্রিষ্টের জন্মের কথা উল্লেখ নেই। আদি যুগের খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে, এই তারিখের ঠিক নয় মাস পূর্বে মেরির গর্ভে প্রবেশ করেন যীশু। অনেকে যিশুকে সূর্যের সন্তান বলে অভিহিত করেন। খ্রিস্টানরা মূলত যীশু খ্রিস্টের বেঁচে ওঠা, তথা পুনরুত্থানের অলৌকিক ঘটনাকে স্মরণ করার জন্য ‘২৫ ডিসেম্বর’কে বাৎসরিক ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালন করে থাকেন। খ্রিস্টানদের কাছে এই দিনটি তাঁদের স্রষ্টার জন্মদিন। আবার কিছু সম্প্রদায়ের কাছে স্রষ্টার সন্তানের জন্মদিন হিসেবে পরিচিত। এই দিনটিতে তারা বিভিন্ন রকম আলোকসজ্জা, খাবার, চা পান সহ বিভিন্ন রকম উপহার আদান-প্রদান করেন। ঐতিহাসিক রোমান উৎসব দিবসের সঙ্গে মিল রেখে ২৫ ডিসেম্বর যীশুখ্রীষ্টের জন্ম উৎসব পালনের সূত্রপাত হয়। ইংরেজি ‘ক্রিসমাস’ শব্দটি দুটি অংশ। একটি ‘ক্রিস’ আরেকটি শব্দ ‘মাস’। ক্রিস শব্দটি ঈসা – এর একটি উপাধি। আর ‘মাস’ শব্দের অর্থ জন্মদিন বা জন্ম উৎসব। সুতরাং ‘ক্রিসমাস’ দ্বারা হযরত ঈসা-র জন্ম উৎসবকে বোঝানো হয়ে থাকে।


যীশু খ্রিস্টের জন্মদিন বলে শোনা গেলেও, ২৫ ডিসেম্বরের কিন্তু সত্যিই তেমন কোনও প্রমাণিত ঐতিহাসিকতা আছে কি না, এ নিয়ে তত্ত্ব-তর্ক প্রচুর। যীশু কবে জন্মেছেন, তার ঐতিহাসিক নথি আছে বলে মনে করেন না বিশেষজ্ঞরা। বরং অনেক প্রাচীনকালে যখন ‘ইয়ুল’ বলে পরিচিত ছিল এই দিনটি, তাকে মনে করা হত সূর্যের দক্ষিণাবর্ত বা মকর-পরিক্রমার শেষ বিন্দু (উইন্টার সলস্টিস), এবং সেই দিক দিয়ে— ধর্মীয় নয়— প্রাকৃত গুরুত্বে অন্বিত। প্রাচীন খ্রিস্টীয় সমাজ সাধারণ ভাবে যীশুর জন্মানুষঙ্গে দিনটিকে জড়াত না, এমনকি এই যুক্তিও শোনা যেত যে জন্মদিন বলে কিছু হতে পারে না, বিশেষত সেই বড় মানুষজনের ক্ষেত্রে, যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন মানব-স্বার্থে। বরং মানবমঙ্গলের জন্য তাঁদের বলিদানের দিনটিকেই জন্মদিন বলে ধরা যেতে পারে, যদি জন্মদিন বলে আদৌ কিছু মানতে হয়। নিউ টেস্টামেন্টেও ২৫ ডিসেম্বরের কোনও গুরুত্ব বলা নেই। মনে করা হয়, আনুমানিক ২২১ অব্দ নাগাদ এই দিনটিকে যীশুর জন্মের সঙ্গে প্রথম বার যুক্ত করেছিলেন সেক্সটাস জুলিয়াস আফ্রিকানাস, যিনি ছিলেন জেরুসালেম-এর নামকরা ইতিহাসবিদ, বা ঠিক করে বলতে গেলে, ইতিহাসভিত্তিক কাহিনি-লেখক। কিন্তু তখনও দিনটিকে ‘ডে অব দ্য বার্থ অব দি আনকনকার্ড সান’ বলা হত। তাই কেউ কেউ ভাবেন, এখানেই হয়তো ক্রমে মিলে গিয়েছিল ‘সান’ (সূর্য) এবং ‘সান’ (পুত্র, অর্থাৎ ঈশ্বরপুত্র) অর্থাৎ যীশু— এই দুই শব্দ, মিলে গিয়েছিল প্রাকৃত ও ধর্মীয় ব্যঞ্জনা। আজও এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ঘাঁটলে এমন ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।
ধারণা করা হয়, ৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে ক্যাথলিক রাজা কনস্ট্যানটাইনের আমলে প্রথম বড়দিন পালন করা হয়। এর কয়েক বছর পর পোপ জুলিয়াস ২৫ ডিসেম্বর ‘ক্রিসমাস’ হিসেবে উদযাপন হবে ঘোষণা করেন। ভারতবর্ষে ১৬৬৮ সালে প্রথম ক্রিসমাস পালন হয়। অনেক অর্থোডক্স ও কপ্টিক চার্চ এখনো ৭ জানুয়ারি ‘বড়দিন’ পালন করে। তারা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের বদলে জুলিয়ান দিনপঞ্জি অনুসারে দিবসটি পালন করে থাকে।

ক্রিসমাসের আগে থেকে পুরোপুরি বাদ পড়েনি ‘হ্যাপি’। এখনও ইংল্যান্ডে ব্যাপক ভাবেই ক্রিসমাসের আগে ‘হ্যাপি’ই বসানো হয়। এমনকী ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ নিজেও বড়দিনের শুভেচ্ছা জানাতে ‘হ্যাপি ক্রিসমাস’ই বলতেন। তার কারণ নাকি রানির মতে, ‘মেরি’টা যথেষ্ট পরিমাণে ভদ্র শব্দ নয়। এমনকী ইংল্যান্ডের কিছু স্বঘোষিত সম্ভ্রান্ত পরিবার এখনও ‘মেরি’ শব্দটা ব্যবহার করে না। তাদের মতেও, এটা একেবারে অসভ্য গুণ্ডাদের ভাষা। ‘হ্যাপি’টাই ভদ্রলোকের ব্যবহার করার উপযুক্ত। সে দেশের অনেক চার্চেও সেই রীতিই চলছে।

খ্রিষ্টধর্মের এই গুরুত্বপূর্ণ দিনটিকে “মেরি ক্রিসমাস”, বলে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য পাদ্রিরা হ্যাপির বদলে ক্রিসমাসের আগে মেরি বসান। এরপর থেকে রক্ষণশীল ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরাই হ্যাপি ক্রিসমাস বলে শুভেচ্ছা বিনিময় শুরু করেন। অনুমান, ১৫৩৪ সালে ক্রোমওয়েলকে ‘মেরি ক্রিসমাস’ লিখে একটি চিঠি লিখেছিলেন বিশপ জন ফিশার। তবে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ইংল্যান্ড-সহ ইউরোপের নানা জায়গায় বার্তা হিসেবে জনপ্রিয় হয় ‘মেরি ক্রিসমাস’। ক্রিসমাস কার্ড কিংবা উপহারে মেরি ক্রিসমাস লেখাটি ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের সবর্ত্র। পরবর্তীতে ইউরোপ পেরিয়ে গোটা বিশ্বজুড়ে মেরি ক্রিসমাস জনপ্রিয় হয়ে। এভাবেই ‘হ্যাপি’ থেকে ‘মেরি ক্রিসমাসে’র ব্যবহার শুরু।

উনিশ শতকের গোড়া থেকেই ইংল্যান্ড-সহ ইউরোপের নানা জায়গায় ‘মেরি ক্রিসমাস’ই শুভেচ্ছাবার্তা হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে যায়। পরে আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়ে এই রীতি। ক্রিসমাস-কার্ডে ব্যাপক ভাবেই লেখা হতে থাকে ‘মেরি ক্রিসমাস’।

এই পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে অসুবিধা নেই, কেন আজও মধ্য এশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের বেশ কিছু দেশে যীশুর জন্মদিন বলে পালিত হয় জানুয়ারির ৬ বা ৭ তারিখ। ওই তালিকায় রয়েছে মিশর, ইথিয়োপিয়া, কিংবা বেলারুস, জর্জিয়া, সার্বিয়া, এমনকি রাশিয়ার কিছু অংশ। আর্মেনিয়ানরা পালন করে থাকেন ৬ জানুয়ারি। তবে কিনা, সেই পুরাকালে, রোমান চার্চ ‘২৫ ডিসেম্বর’ দিনটিকেই বেছে নেওয়ার পর যেন এই বিতর্ক-ইতিহাসে একটি অদৃশ্য মীমাংসার যবনিকা নেমে এসেছিল, কেননা ক্রমে সেই রোমান খ্রিস্টীয় সংস্কৃতির ধারাতেই স্নাত হয়েছিল ইউরোপের বহুলাংশ এবং তারপর উপনিবেশ-যুগ শুরু হলে ইউরোপের এই ধারাই বিশ্বের নানা অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল একটি স্বীকৃত রূপ হিসাবে। বাস্তবিক, যা ছিল এক পারিবারিক উৎসব, চার্চে গিয়ে নিস্তরঙ্গ আরাধনার দিন, তা দাঁড়িয়ে গেল এক সামাজিক উৎসবে। এই ঘটনাকে মূলত উপনিবেশ-যুগের অবদান বললে ভুল হবে না। নিজ ভূমি থেকে বহু দূরে, স্থানান্তরিত ইউরোপীয় খ্রিস্টানরা এই ছুটির দিনটিতে স্বদেশে না থাকার ব্যথা অনুভব করতেন, এবং সম্মিলিত হয়ে নানা উৎসবে মেতে উঠতেন। কলকাতার দিকেই যদি তাকানো যায়, বিলিতি হাতে শহরের নতুন পত্তন হওয়ার পর প্রথম থেকেই এই দিনটিতে আমোদিত হয়ে উঠতেন শহরবাসী পশ্চিমিরা এবং পশ্চিমি সংস্কৃতিবহ্নিতে আকৃষ্ট ‘নেটিভ’ পতঙ্গরা। সকলে মিলে ভিড় করতেন শহরের ‘সাহেব-পাড়া’য়। আজও ইউরোপ-আমেরিকায় দিনটি পারিবারিক মিলনের দিন, অথচ ভারতে কিংবা এশিয়ার অন্যান্য উপনিবেশ-ইতিহাস অধ্যুষিত দেশে এই দিনটি হুল্লোড়-আনন্দের দিন, বাইরের উৎসবে ভেসে যাওয়ার দিন। আমেরিকা বা ইংল্যান্ডে এখনও এই দিনটি ও তারপরের দু’-একটি দিন সব দোকান বন্ধ, সবার ছুটি, সবার বাড়ি ফেরার তাড়া— আর ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল কিংবা মালয়েশিয়ার মতো দেশে বড়দিনের কেনাকাটা, হইচই, মাতামাতি আর বেড়ানোর ধুম।
ক্রিশ মাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে ‘ক্রিসমাস ট্রি’। প্রায় হাজার বছর আগে উত্তর ইউরোপে ক্রিসমাস উৎসবের অঙ্গ হয়ে ওঠে এই গাছ। ১৫ শতকের শেষের দিকে প্রথমবার ক্রিসমাস ট্রি এর ব্যবহার হয়েছিল। ১৪৪১ সালে এস্তোনিয়ায় । আবার অনেকের মতে, লাটভিয়ার রিগাতে ১৫১০ প্রথমবার এই গাছের ব্যবহার হয়। ষোড়শ শতকে জার্মানিতে প্রথমবার ঘরের ভেতর ‘ক্রিসমাস ট্রি’ অর্থাৎ ‘ফার গাছ’ এনে বড়দিন পালন করা হয়। ধীরে ধীরে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লে এই গাছ। ১৮ শতকে থেকে আমেরিকায় জার্মানদের কল্যাণে প্রবেশ করে ক্রিসমাস ট্রি। আরো অনেক পরে ইংল্যান্ডে ক্রিসমাস ট্রির আগমন ঘটেছে। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি সেখানে এই গাছটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। ইউরোপে গণ্ডি ছাড়িয়ে ক্রিসমাস ট্রি এখন সারা দুনিয়া জুড়েই। তবে গাছের গায়ে আর কোন রং থাকুক বা না থাকুক লাল, সবুজ, সোনালী, রুপালী, রং থাকবেই। রঙ না থাকলেও সেই রংয়ের আলো থাকবে। যিশু তো নিজেই ভগবানের দূত। আলো সেই অসীম জ্ঞানের প্রতীক বলে মনে করা হয়। বাকিটা ইতিহাস।

যিশুখ্রিস্টের জন্ম উৎসব দিবসটিকে বাংলায় কেন ‘বড়দিন’ বলা হয় তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে – ২৩ ডিসেম্বর থেকে দিন ক্রমশ বড় এবং রাত ছোট হতে আরম্ভ করে। তাই উক্ত দিনটি থেকে যিশুখ্রিস্টের জন্ম উৎসব শুরু; এবং বাংলায় ‘বড়দিন’ আখ্যা দেয়া হয়।

এভাবেই দিনটি ভিতরে বাইরে দুই দিকেই ‘বড়’ হয়েছে ক্রমে। তা ছাড়া, স্পষ্ট কোনও ধর্মীয় নিদান না থাকার কারণেই হয়তো, ধর্মাচারও থেকেছে নামমাত্র, কিংবা অনুপস্থিত, এবং এক সঙ্গে এক উৎসবের ছাতার তলায় নিয়ে এসেছে নানা ভাষা নানা মত নানা ধর্মের মানুষকে। এই যেমন, মালয়েশিয়ার মতো ‘ইসলামি’ দেশটিতে বড়দিনই নাকি সবচেয়ে জনপ্রিয় জাতীয় উৎসব। এই প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক, একেবারে গোড়ার প্রশ্নটিতে। ভেদাভেদ না মেনে সকলের কাছেই বড়দিন আনন্দের দিন হয়ে উঠতে পেরেছে বলেই হয়তো ‘বড়দিন’ সত্যিই খুব ‘বড়’ একটি দিন।

ইদানিংকালে কলকাতার ক্রিসমাস ও বর্ষবরণ উৎসবের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে এসপ্ল্যানেড-পার্ক স্ট্রিট এলাকা। অথচ কলকাতা গড়ে ওঠবার প্রথম পর্বে পার্ক স্ট্রিট রাস্তা তৈরিই হয়েছিল বিভিন্ন জায়গা থেকে উচ্ছেদ হওয়া দরিদ্র শ্রেণির লোকজনের থাকার জন্য। পার্ক স্ট্রিট নামকরণ অনেক পরে হলেও রাস্তাটা তৈরি হয়েছিল ১৭৬২ নাগাদ। সেই সময়ে ওই রাস্তার পূর্ব দিকে ছিল অনেকগুলো খ্রিশ্চান কবরখানা তাই লোকমুখে রাস্তাটার নাম হয়েছিল ‘গোরস্তান কা রাস্তা’ আর সাহেবরা বলত ‘বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড’।

ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে ‘লটারি কমিটি’ ওই এলাকা থেকে দরিদ্র লোকজনের বাস তুলে দিয়ে ইউরোপিয়ানদের বাসস্থান তৈরি করে। তখন থেকে ওই এলাকা ‘সাহেবপাড়া’ নামে পরিচিত এবং শীতের সময়ে বড়দিন পালনের রেওয়াজ চালু হয়। যা এখন আরও বিরাট আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম আকর্ষণের জায়গা হল কলকাতার পার্কস্ট্রিট। সাহেবি কায়দা, বিদেশি খানাপিনা আর বিলাসিতায় ভরপুর শহরের এই রাজপথ অত্যন্ত জনপ্রিয়। ভারতের অন্যতম পুরনো শহরগুলোর মধ্যে কলকাতা হল অন্যতম। তাই প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি পুরনো আমলের বাড়ির রয়েছে এক একটি কাহিনি। বাদ যাবে না পার্কস্ট্রিটও।

ব্রিটিশ আমলের এই রাস্তা বর্তমানে এতটাই জনপ্রিয় যে ক্রিসমাসের সময় তিল ধারণের জায়গা থাকে না। জেলা থেকে শহর, সব জায়গা থেকে এদিন মানুষ পার্কস্ট্রিটের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে শুধু হেঁটে যায়। সঙ্গে থাকে কেক-পেস্ট্রি, কমলালেবু, কফি।

ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে, পার্কস্ট্রিটের ওপরই ছিল বিখ্যাত সাহেবি নাট্যশালা সাঁসচি থিয়েটার। সেখানেই রয়েছে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ। রয়েছে ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম, এশিয়াটিক সোস্যাইটি, সাউথ পার্কস্ট্রিট সিমেট্রি। কিন্তু এই বাড়িগুলো দেখার জন্য ক্রিসমাসের সময় মানুষজন ভিড় করেন না। তাহলে এইসময় রাস্তায় বাঙালি কেন হেঁটে পা ব্যাথা করে? ইতিহাস বলছে, পার্কস্ট্রিটের ওপর ছিল গভর্নর ভ্যানসিটার্টের নিবাস। পুরনো আমলের বাড়ির ধাঁচে তৈরি বাংলোর পাশেই ছিল পাঁচিল ঘেরা এক বিশাল বাগান। এই বাগানের মালিক ছিলেন উইলিয়াম ফ্র্যাঙ্কল্যান্ড নামে এক সাহেব। বাগান লাগোয়া ঐতিহ্যপূর্ণ বাড়িটির মালিক গভর্নর হেনরি থাকলেও বেশি বছর থাকতে পারেননি। কারণ নবাব সিরাজদৌল্লার কলকাতা আক্রমণের সময় প্রাণ বাঁচাতে পরিবারকে ফেলে পালিয়ে যান তিনি। তারপরে ১৭৭৪ সাল থেকে ১৭৮২ সাল পর্যন্ত ওই বিলাসবহুল বাড়িতে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি স্যার ইলোজা ইম্পে। বাড়ির চতুর্দিকে ছিল একটি বিশাল ডিয়ার পার্ক। বিচারপতির শখের জন্যই রাখা হয়েছিল প্রচুর হরিণ। এর বিস্তার ছিল ক্যামাক স্ট্রিট থেকে রাসেল স্ট্রিট, দক্ষিণের দিকে বেরিং গ্রাউন্ড রোড পর্যন্ত। ছিল গাছে ঘেরা ফটক। সেই থেকে এই রোডের নাম হয় পার্কস্ট্রিট।

কলকাতার বড়দিন পালনের অন্যতম কেন্দ্র পার্ক স্ট্রিট ও সংলগ্ন অঞ্চলে আজ যে সমারোহ হয় তার ইতিহাস খুব বেশি হলে দু’শো বছরের। শুরুতে অবশ্য শুধু খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসীরাই এই উৎসবে যোগ দিতেন পরে তা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এখন তো গোটা পার্ক স্ট্রিট এলাকাটা আলোকমালায় সাজানো হয়। সেই সঙ্গে এখানকার অ্যালেন পার্কে থাকে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও।

কলকাতায় ক্রিসমাসের আসল উত্তেজনা ও স্বাদ পেতে হলে যেতে হবে মধ্য কলকাতার বো ব্যারাকে। আলো, ক্রিসমাস ট্রি, বিদেশি সুস্বাদু খাবার, রেড ওয়াইন, কেক ও উষ্ণ আতিথেয়তার উজ্জ্বল মুখ দেখা যায় এই এলাকায়।
ইতিহাস বলে, যীশু খ্রিস্টের জন্মদিন পালনের এই রীতি গোড়ার দিকে শুধু খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাও সেটা শুরু হয় অনেক পরে, চতুর্থ শতাব্দীতে এবং তা সীমাবদ্ধ ছিল কেবলমাত্র খ্রিস্টিয় ধর্ম অনুসরণকারী ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে। ইউরোপের বিভিন্ন খ্রিস্টিয় রাষ্ট্র যখন বাণিজ্যের জন্য এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ দখল আরম্ভ করলো, সেই সময়ে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে খ্রিস্ট ধর্মের প্রচারকেরাও এই সব দেশে আসে এবং যীশুর মাহাত্ম্য প্রচার ও ধর্মান্তকরণ আরম্ভ করে। ষোড়শ শতকে পশ্চিম ভারতে পর্তুগিজ বণিকদের আসা থেকে এ দেশে খ্রিস্টধর্ম প্রচার ভালোভাবে আরম্ভ হয়। সেটা আরও শক্তপোক্ত হল, ব্রিটিশদের উপনিবেশ তৈরি হওয়ার পর।
ব্রাহ্ম সমাজের উদ্যোগে যীশু খ্রিস্টের জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বর তারিখে ‘খ্রিস্টোৎসব’ পালনের রীতি প্রচলিত হয়। রবীন্দ্রনাথও শান্তিনিকেতনের কাঁচ মন্দিরে ‘খ্রিস্টোৎসব’ পালন শুরু করেন।