শারদীয় দুর্গোৎসব থেকে শ্যামা পূজা, আলোক দূষণ ক্রমশ বাড়ছে

শোভনলাল চক্রবর্তী

বিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় আলো এক ধরনের শক্তি বা বাহ্যিক কারণ, যা চোখে প্রবেশ করলে দেখার অনুভূতি জন্মায়। আলো বস্তুকে দৃশ্যমান করে নিজে অদৃশ্য থাকে, তির্যক তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের আকারে এক স্থান থেকে আর এক স্থানে যায়, এবং মাধ্যমভেদে বেগের পরিবর্তন হয়। সে যা-ই হোক, নিবিড় ঘন আঁধারে উজ্জ্বল ধ্রুবতারার মতো আলোই প্রাণিকুলের সান্ত্বনা। মনকে পাথারে দিশেহারা, বিষাদে ম্রিয়মাণ না-হতে বলতে পারার অবলম্বন। আলো মানে খারাপ থেকে ভাল, অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগের পেট চিরে নবজাগ্রত আধুনিকের ভূমিষ্ঠতা। বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, “যখন বাইরে-ভেতরে কোথাও/ আলো নেই,/ তোমার শূন্যতার অজ্ঞাত গহ্বর থেকে নবজন্মের জন্য/ প্রার্থনা করো, প্রতীক্ষা করো, প্রস্তুত হও।”রবীন্দ্রনাথের গান মানেও আলোয় ভরা এক ভুবন। অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত এক আলোয় ধোওয়া নয়ন যেখানে দেখছে সদাই। আলোয় হরা হৃদয় যেখানে জাগ্রত। যেখানে প্রাণের মাঝে আলো নাচে, হৃদয়বীণার মাঝে আলো বাজে। বাংলা আধুনিক গানেও তো আলো আর আনন্দ, এক দিকে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গেয়ে ওঠেন “নতুন সূর্য, আলো দাও”, ও পাশে মান্না দে, “অন্তরে অন্তরে দাও আলো দাও, কালিমা-কলুষ যত মুছে নিয়ে যাও।” সলিল চৌধুরী সমাজ বদলের স্বপ্ন-দেখা অগ্রণী সেনানীদের ডাকেন ‘আলোর পথযাত্রী’ বলে।

শারদীয়া উৎসবের চেয়ে কম আলোর স্রোতে ভাসে না শ্যামা-আরাধনার আয়োজন। কিছু বিশেষ জায়গায় তুলনায় আড়ম্বর বেশি। আর আছে বাজি পোড়ানোর ধুম। কালীপুজো তো ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায়’ আলোর নাচন দেখার উৎসব। কয়েক দশক আগে থেকে কালীপুজো ও তৎসংলগ্ন দিনগুলিতে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ-জনিত সচেতনতা ও ব্যবস্থাপনা, সতর্কীকরণ, ধরপাকড়, জেল-জরিমানা, গ্রিন ট্রাইবুনাল, আদালত, বাজি বিক্রেতা সংগঠন, শব্দসীমার পরিমাপ ইত্যাদি বহুল আলোচিত। বাজির কথা যদি ছেড়েও দিই, আলো দূষণও কি শুধু কালীপুজো বা বিশেষ কোনও উৎসবের দিনেই হয়! ফিলামেন্ট-নির্ভর বাল্‌ব-এর হলদেটে আলোর চেয়ে এলইডি-র সফেদ আলোর উজ্জ্বলতা বহু গুণ, শহরের মোড়ে-মোড়ে, জায়গায়-জায়গায় ‘হাই মাস্ট’ বাতিস্তম্ভ। আগে পার্ক স্ট্রিট সেজে উঠত বড়দিনে, এখন সেই সাজ পরেই তাকে থাকতে হয় প্রায় সম্বৎসর। নিউ টাউন-রাজারহাটের ‘বিশ্ববাংলা সরণি’তে সাধারণ সময়েও হঠাৎ করে চলে এলে শহরে দুর্গাপুজো হচ্ছে ভেবে বসা অস্বাভাবিক নয়, কারণ তার সর্বাঙ্গের আলোর সজ্জা খোলা হয় না। কে বহন করে এই বিপুল খরচ! যে-ই করুক, টাকাটা জনগণের। বিদ্যুৎ মাসুল, জিএসটি তাঁদেরকেই দিতে হয়। পথবাতির স্তম্ভগুলিও ক্ষেত্রবিশেষে যে দূরত্ব রেখে বসানো হয়, কিছু ক্ষেত্রে তার চেয়ে ব্যবধান বেশি রাখলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না, কে বোঝাবে!


স্বাভাবিকভাবে আমরা পরিবেশ, মাটি, জল, বায়ু, শব্দ ইত্যাদি দূষণের কথা জানি। আলোক দূষণ নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না। কিন্তু এটি আমাদের সমাজ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আলোক দূষণ হলো অবাঞ্ছিত, অনুপযুক্ত বা অতিরিক্ত কৃত্রিম আলোর উপস্থিতি। প্রশ্ন উঠতে পারে, আলোক দূষণ কীভাবে জীববৈচিত্র্যে প্রভাব ফেলে? সিডনির অপেরা হাউসের ওপর আকাশে প্রায়ই একটি দৃশ্য লক্ষ করা যায়। রাতের বেলায় অপেরা হাউসের কৃত্রিম উজ্জ্বল আলোয় প্রলুব্ধ হয়ে কিছু পাখি এদিক-সেদিক ওড়াওড়ি করে। উজ্জ্বল আলোয় দিকভ্রান্ত হয়ে এরা নিজেদের বাসার রাস্তা হারিয়ে ফেলে। ফলে নির্দিষ্ট দিক খুঁজে পাওয়ার জন্য এদিক-সেদিক উড়তে থাকে। একটানা দিকভ্রান্ত হয়ে ওড়ার কারণে এরা প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ক্লান্ত দেহে আছড়ে পড়ে আশপাশের কোনো বিল্ডিংয়ের গায়ে। ফলাফল মৃত্যু। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর সিডনি অপেরা হাউসের উজ্জ্বল আলোয় বিভ্রান্ত হয়ে হাজার হাজার পাখি মারা যায়।একই দৃশ্য পুজো পার্বণের উৎসবের আলোকিত শহরেও দেখা যায়। গাছের পাখি সারা রাত ধরে কিচির মিচির করে চলে। উজ্জ্বল আলোয় তারা রাতকে দিনের সঙ্গে তফাৎ করতে পারে না। উৎসবের সময় শহর জুড়ে জ্বলতে থাকা চড়া কৃত্রিম আলোয় মারা পড়ে হাজার হাজার পতঙ্গ।

পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে আলোক দূষণের এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। ২০২৩ সালের ‘ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস অফ আর্টিফিশিয়াল নাইট’-এর স্কাই ব্রাইটনেসের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের জনসংখ্যার ৮৩ শতাংশ এরকম আলোক দূষিত আকাশের নিচে বাস করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ৯৯ শতাংশ মানুষ প্রাকৃতিক রাত উপভোগ করতে পারে না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, আলো যেখানে প্রয়োজন, শুধু সেখানেই ব্যবহার করা উচিত, অপ্রয়োজনীয় আলো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।আমাদের সমাজের সব স্তরেই আলোক দূষণ একটি সমস্যা হিসাবে উপনীত হয়েছে। এ দূষণের ফলে যেসব সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে, তার জন্য আমাদের যথেষ্ট সচেতন হওয়া প্রয়োজন। রাতে নিজের বাসস্থান থেকেই আলো কমানো শুরু করতে হবে।

বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণায় বিশ্বব্যাপী আলোক দূষণ কমাতে পাঁচটি মূল কৌশল ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে, যা হলো-পূর্ববর্তী অন্ধকার অঞ্চলে আলোর ভূমিকা এড়ানো, আলো সর্বনিম্ন ব্যবহারযোগ্য তীব্রতায় ব্যবহার করা, আলো যেখানে প্রয়োজন, কেবল সেখানেই ব্যবহার করা, প্রয়োজনের সময়ই কেবল আলো ব্যবহার করা, তীব্র সাদা বর্ণালীর পরিবর্তে কমলা রঙের আলো বেশি ব্যবহার করা।আমাদের পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের এ ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে। আধুনিকতার নামে রাতের বেলা যত্রতত্র আলো জ্বালিয়ে রাখা আলোক দূষণের বড় একটি কারণ। আমরা পুরো পৃথিবীর আলোক দূষণ কমাতে বা বন্ধ করতে পারব না; কিন্তু আমার দ্বারা অন্তত আর কখনো যেন আলোক দূষণ না হয়, তা নিশ্চিত করা সম্ভব। আমাদের প্রত্যেকের সচেতনতায় আলোক দূষণমুক্ত হোক এই পৃথিবী।নিন্দুকরা বলেন রাজ্যে শিল্প নেই। বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত, অন্য রাজ্যের ক্রেতা সুলভ নয় সব সময়। বিদ্যুৎ মাসুলও এ রাজ্যে সারা দেশের মধ্যে চড়া। অথচ সন্ধে না হতেই আলোয় সব কিছু ধুয়ে দেওয়ার কমবেশি আয়োজন রাজ্য জুড়ে। তাতে কুলায় ফিরে আসা পাখিদের কাঙ্ক্ষিত অন্ধকার মুছে যাক, অচেনা অসহায়তায় পরিত্রাণহীনতা নিদ্রাহীনতা তাড়া করুক তাদের, কার দায় সে খবর রাখার! কার কী যায় আসে, যদি এক জোড়া কপোত-কপোতীর থেকে কেড়ে নেওয়া হয় কড়ি-বরগার আবডাল! কিনু গোয়ালার গলিতে সান্ধ্য-সোহাগে কাছাকাছি আসার অবকাশ পেত ব্যক্তিগত পরিসর কেনার ক্ষমতাহীন এক জোড়া কপোত-কপোতী, রাস্তায় কোনও বাতি ছিল না, কে বা কারা যেন ঢিল মেরে বার বার ভেঙে দিয়ে যেত টিমটিমে আলো।

আলো খুব দরকার। তবে অতটাও দরকার নেই, যখন বাঁশবাগানের মাথার উপরে বা ইলেকট্রিকের তারে ঝুলতে থাকা চাঁদ দেখার ন্যূনতম নিবিড়তাটুকু উধাও হয়ে যায় বেমালুম। যানবাহনের আলোর এমন চোখ-ধাঁধানো উজ্জ্বলতা কি কাম্য, যা বিহ্বল করে দেয় রাস্তা পেরোতে চাওয়া পথিককে! আলো খুব দরকার, কিন্তু রাতে পৃথিবীকে তাপ বিমোচনের সবচেয়ে বেশি সুযোগ করে দেওয়াও কি দরকার নয়? নইলে বছরে এক দিন ‘পৃথিবী দিবস’ বলে দু’-এক মিনিট ঘরের আলো নিভিয়ে রাখতে গৃহস্থকে অনুরোধ জানিয়ে কী লাভ!