কুণাল কামরার কমেডি শো নিয়ে শিবসেনার গুন্ডামি দেখে অনেকে খেয়াল করিয়ে দিচ্ছেন, শিবসেনার আদিপুরুষ বালাসাহেব ঠাকরে নিজে কার্টুনিস্ট ছিলেন, ইন্দিরা গান্ধীর ব্যঙ্গচিত্রও এঁকেছেন ইত্যাদি। কিন্তু ওসব কথা বলে লাভ নেই। বাল ঠাকরে শিবসেনার নেতা হিসাবে মোটেই কোনো গণতান্ত্রিক ব্যক্তি ছিলেন না। শিবসেনা কীভাবে মুম্বই চালাত সেকথা সে যুগের মুম্বই তথা মহারাষ্ট্রের বাসিন্দারা প্রত্যেকেই জানেন। নয়ের দশকের মুম্বই দাঙ্গায় শিবসেনার ভূমিকাও কোনো গোপন তথ্য নয়। আজ যে সারা ভারতে সুনির্দিষ্ট পরধর্মবিদ্বেষী এবং পরজাতিবিদ্বেষী গুন্ডামি চালু করেছে সংঘ পরিবার, তার সূচনা অনেক আগেই বালাসাহেব করে দিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রে। মুসলমান তো বটেই, সেইসময় শিবসেনার আক্রমণের বড় লক্ষ্য ছিলেন দক্ষিণ ভারতীয় শ্রমজীবী মানুষজন। ফলে কুণালের শো নিয়ে গুন্ডামি করে এক অর্থে একনাথরা প্রমাণ করে দিলেন যে তাঁরাই বাল ঠাকরের যথার্থ উত্তরাধিকারী, উদ্ধব ঠাকরেরা নন।
ভারতে স্ট্যান্ডআপ কমেডি নতুন কিছু নয়। আগেকার সেই গ্রাম গঞ্জের রঙ্গ-তামাশার আসর থেকে, দি গ্রেট ইন্ডিয়ান লাফটার চ্যালেঞ্জ হয়ে, আজকের ‘এইসি তেইসি ডেমোক্রেসি’। এরই মধ্যে রয়েছেন একজন কুণাল কামরা আর একজন মুনাওয়ার ফারুকী। বছর চারেক আগে মুনাওয়ার ফারুকীর গ্রেপ্তারের খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছিল। সাম্প্রতিক সময়ে, ইন্টারনেটে, আপনি যতবার কুণাল কামরার বিরুদ্ধে হওয়া আদালত অবমাননার মামলার কথা পড়েছেন, নিশ্চিতভাবেই ততবার মুনাওয়ার ফারুকীর গ্রেপ্তারের কথা পড়েননি। কিন্তু, অধিকারের প্রশ্নে মুনাওয়ারের গ্রেপ্তারি ছিল অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিক কারণ, কুণাল এবং মুনাওয়ার দুজনেই স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান হলেও, মুনাওয়ার বয়স এবং অভিজ্ঞতায় কুনালের থেকে ছোট। এবং, মুনাওয়ারের জনপ্রিয়তা বেড়েছে অনেক দ্রুত, উপরন্তু, মুনাওয়ার মুসলিম ধর্মালম্বী, অতএব, অনুভূতি আহত হওয়ার যথেষ্ট কারন বিদ্যমান।
মুনাওয়ারের দোষের মধ্যে ছিল, মধ্যপ্রদেশের এক বিজেপি এমএলএর ছেলের অভিযোগের ভিত্তিতে, ইন্দোরের পুলিশের মনে হয়েছিল যে, একটি কমেডি শোতে মুনাওয়ার এমন কিছু রসিকতা করতে চলেছিল যার মাধ্যমে, দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ এবং কিছু হিন্দু দেব-দেবীর অবমাননা হতেও পারতো। যেহেতু মুনাওয়ার মুসলিম ধর্মাবলম্বী তাই, সেই ক্ষেত্রে, হয়তো, হিন্দু ধর্মাবলম্বী অনেক মানুষের ধর্মানুভূতি আহত হতে পারত। যদিও এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমান ইন্দোরের পুলিশ কোর্টে জমা দিতে পারেনি, কিন্তু তাও, শুধু এই কারনেই প্রায় এক মাসের ওপর মুনাওয়ার, এবং তার ম্যানেজার ও উক্ত কমেডি শোয়ের সংগঠকরা ইন্দোরের জেলে থাকতে বাধ্য হয়েছে। মুনাওয়ারের বিরুদ্ধে কোভিড-১৯ ভাইরাস ছড়ানোর এবং ওই সংক্রান্ত গাইডলাইন্স না মানার অভিযোগও ছিল। তার জামিনের আবেদন প্রথমে ট্রায়াল কোর্ট, আর তারপর মধ্যপ্রদেশ হাই কোর্ট খারিজ করে এবং শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন পেতে হয় মুনাওয়ারকে। সুপ্রিম কোর্ট জামিন দেওয়ার সময় বলে যে, মুনাওয়ারের বিরুদ্ধে নাকি কোনো সুস্পষ্ট অভিযোগ আনতেই পারেনি পুলিশ!
আজকের মুম্বইতে দাঁড়িয়ে নাম করে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, ফড়নবীশ, মুকেশ আম্বানি, তাঁর ছেলে, আনন্দ মাহিন্দ্রা এবং নাম না করে একনাথকে নিয়ে মস্করা করার সাহসের পিছনে কুণাল যে রাজ্যে থাকেন তার নিরাপত্তা কাজ করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ব্যাপারটার মধ্যে কৌশল আছে বলে কুণালের সাহসকে এক বিন্দুও ছোট করা যায় না। কারণ সাম্প্রতিক অতীতে বিজেপিশাসিত রাজ্যে অভিযোগ দায়ের করে অন্য রাজ্যের লোককে গ্রেফতার করার দৃষ্টান্তও বিরল নয়।
আজকের কুণালের দিকে সেদিনের কুণালের যাত্রা শুরু তখন থেকে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে তাঁর যে ভিডিও আপলোড হয় সেখানে কুণাল এসে দাঁড়ান একখানা কালো টি শার্ট পরে, যার উপর বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘WAH MODIJI WAH’। মঞ্চে এসেই তিনি দর্শকদের জিজ্ঞেস করেন ‘আমার আর আম্বানিজির মধ্যে মোদীজি কী করছেন? আমি সোজা আম্বানিকে কেন ভোট দিতে পারি না?’ হাসাহাসির মধ্যে দিয়ে কুণাল একবিংশ শতকের বিশ্ব রাজনীতির এক নিদারুণ সত্য উদ্ঘাটন করে ফেলেন – আজকের রাজনীতিকে চালায় আসলে বড় বড় কর্পোরেট হাউসগুলো। তখনো কিন্তু মোদীর সঙ্গে আম্বানি, গৌতম আদানির সম্পর্কে নিয়ে রাহুল গান্ধী সরব হননি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের হয়ে ইলন মাস্কের লম্ফঝম্প কোনোদিন দেখতে হবে – একথাও কেউ কল্পনা করেনি। অথচ কুণাল বলেন ‘আমার মনে হয় কর্পোরেট হাউসের মালিকদেরই ভোটে লড়া উচিত। রতন টাটা বনাম মুকেশ আম্বানি। লড়ো ২০১৯।’ এই কৌতুককে এগিয়ে নিতে নিতেও কুণাল আমাদের এক বুনিয়াদি বিতর্কের দিকে নিয়ে যান। সেটা হল – উন্নয়ন বা বিকাশ মানে কী?
মনে রাখতে হবে, কুণাল সুপ্রিম কোর্টকে আগে থেকেই চটিয়ে রেখেছেন। ২০২১ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্ট যে দ্রুততায় রিপাবলিক টিভির মালিক অর্ণব গোস্বামীর জামিন মঞ্জুর করেছিল, তাকে ব্যঙ্গ করে একগুচ্ছ টুইট করেন। তার জন্যে তাঁর নামে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে কিছু লোক, বিচারপতিরাও আদালত অবমাননার নোটিস পাঠান। কুণাল তার যে জবাব দিয়েছিলেন তাও একই সঙ্গে সাহস ও রসবোধের নিদর্শন। মোদ্দা কথা, তিনি বিচারপতিদের সামনেও মাথা নোয়াননি। শুধু কি তাই? নিজের এক শোয়ে সুপ্রিম কোর্টকে ‘ব্রাহ্মণ-বানিয়া অ্যাফেয়ার’ পর্যন্ত বলে বসে আছেন। এমন লোকের উপর কি আর বিচারপতিরা সদয় হবেন?
স্ট্যান্ডআপ কমেডির জন্মস্থান আমেরিকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, লস অ্যাঞ্জেলেস এবং নিউ ইয়র্ক, আমেরিকার ক্লাবগুলিতে স্ট্যান্ডআপ কমেডির সংস্কৃতি বৃদ্ধি পায়। ১৯৪০ সালে, মিল্টন বার্লি, সিড সিজার এবং জ্যাকি ম্যাসনের মতো স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ানরা আমেরিকায় এই ধারা শুরু করেন। এর পরে, ৫০ থেকে ৭০ এর দশক পর্যন্ত, এই স্ট্যান্ডআপ কমেডি ক্লাব এবং পাবগুলিতে অব্যাহত ছিল এবং তারপরে এটি টিভির পর্দায় তার স্থান করে নেয়। একবিংশ শতাব্দীর অর্থাৎ ২০০০ সালের পরে, এই সংস্কৃতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং এটি ভারতেও তার স্থান করে নেয়। আজ, স্ট্যান্ডআপ কমেডি আমাদের দেশে বিনোদনের একটি বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে, কিন্তু আমাদের কমেডিয়ানদের এখনও বাক স্বাধীনতার অভাব রয়েছে যা অন্যান্য উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ প্রদান করে।
সাম্প্রতিক সময়ে কুণালের মতোই বহু কমেডিয়ান সমালোচিত হচ্ছেন তাঁদের মন্তব্যের জেরে। বিশেষত রাজনৈতিক কোনও নেতা-ব্যক্তির কার্যকলাপ নিয়ে ব্যঙ্গ বা শ্লেষাত্মক মন্তব্য করলেই পড়তে হচ্ছে সরকার-প্রশাসনের কোপে। বহু কৌতুকাভিনেতা ও কমেডিয়ানদের একের পর এক শো বাতিল হয়েছে বা ভাঙচুর করে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। আগের তুলনায় পরিস্থিতি অনেকটাই অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে, কমে আসছে বাকস্বাধীনতার পরিসর।