• facebook
  • twitter
Monday, 28 April, 2025

মাংসের পর মাছ

খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখার কিংবা পোশাক বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত অধিকার। মাছ বাঙালিদের শুধু খাদ্য নয়, বাঙালির সংস্কৃতিরও প্রতীক।

ফাইল চিত্র

বহু জাতি বহু ভাষী ভারতের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের অস্তিত্বই স্বীকার করে না সঙ্ঘবাহিনী ও বিজেপি। যারা অভিন্নতা চাপাতে চায় সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্বের নামে তারা শুধু মুসলিম, খ্রিস্টান বা অন্য ধর্মের মানুষের সংস্কৃতিকেই অস্বীকার করে না, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও বহু সংস্কৃতিকে মানতে চায় না। তাই গরুর মাংস নিষিদ্ধ হচ্ছে বিজেপি শাসিত রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায়। গরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগে, ব্যাগে অথবা ফ্রিজে গরুর মাংস রাখার অভিযোগে পিটিয়ে হত্যার একের পর এক ঘটনা ঘটেছে উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানাতে। এমনকি বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকরা আক্রমণের শিকার হয়েছে। এখন শুধু গরুর মাংসে নিষেধাজ্ঞা সীমিত রইল না, মাছ খাওয়ার ওপরও আক্রমণ নেমে এসেছে।

কিছুদিন আগেই গেরুয়া পোশাকে কয়েকজন দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কের বাঙালিদের কলোনির পার্শ্ববর্তী দোকানিদের হুমকি দিয়ে বলে, পাশে কালীমন্দির, অতএব এখানে মাছের দোকান করা যাবে না, কারণ এটা নাকি সনাতন ধর্মের বিরোধী। প্রথমে উপলক্ষ ছিল রামনবমী, কিন্তু তারপরেও দোকান খুলতে দেওয়া হচ্ছে না। সত্তর দশকের শুরুতে বাজারটি তৈরি হয়। বাসিন্দাদের প্রয়োজনেই মাছ, সবজি, মিষ্টি, মুদির দোকান, সেলুন, রেডিমেড পোশাক ইত্যাদির দোকান তৈরি হয়। যাদব নামে একজন বাজারের সঙ্গেই এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। দোকানদাররাও মন্দির তৈরিতে অর্থ সাহায্য করেছিলেন। পরে দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (ডিডিএ) পুরো বাজারটি ভেঙে ফেলে। নতুন করে বাজার তৈরি হয়। মাছের দোকানের জন্য জায়গা দেওয়া হয়। লাইসেন্স আছে ব্যবসায়ীদের। মন্দিরের জন্যও একটি জায়গা দেওয়া হয়। আগে মন্দিরটি ছোট ছিল। ক্রমশ এলাকার স্থআয়ী বাসিন্দারা মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ফলে ক্রমশ তা বিরাট আকার নেয়। কিন্তু মাছ এবং দেবদেবীর পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ অবস্থানে কোনওদিন সমস্যা ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দুত্ববাদীদের আগ্রাসনের জেরে একই রকম খাবার, পোশাক, ভাষা, বিয়ে, সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় যাঁরা ভারতের মধ্যে বৈচিত্র্যে বিশ্বাসী, তাঁরা গভীর সংকটে পড়েছেন।

মাছের দোকান বন্ধ করতে আসা হিন্দুত্ববাদীদের বোঝানোর চেষ্টা করেন স্থানীয় মানুষজন। বাংলায় কালীপুজোয় আমিষ ভোগ দেওয়া হয়। অসমের কামাখ্যা মন্দিরেও মাংস দেওয়া হয়। সঙ্গে আরও বলা হয়, বাজারটি বেআইনিভাবে গজিয়ে ওঠা নয়, দিল্লি উন্নয়ন অথরিটি দ্বারা অনুমোদিত। স্রেফ গায়ের জোরে সাম্প্রদায়িক শক্তি দিল্লিতে মাছ নিষিদ্ধ করতে আসরে নেমেছে। যেনতেন প্রকারে ওরা ‘হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুত্ব’ কায়েম করতে উঠেপড়ে লেগেছে।’

মাছের দোকান বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি নতুন হলেও রাজধানীর আশপাশের এলাকায় বেশ কিছুদিন ধরে সংস্কৃতি ও খাদ্যাব্যাসের উপরে আক্রমণ বাড়িয়েছে হিন্দুত্ববাদীরা। এখানে দশেরা, রামনবমী ইত্যাদি পালন করা হলেও বাঙালিদের কাছে দুর্গাপুজোর উৎসবই মুখ্য। দুর্গাপুজোর সময় কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের মতোই দিল্লি-এনআরসি’র বাঙালিরাও আমিষ খাবারই পছন্দ করেন। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এই সব এলাকায় সর্বজনীন পুজো কমিটিগুলিকে পুজোর অনুমোদন দেওয়ার আগে কার্যত মুচলেকা দিতে হচ্ছে যে, পুজোর সময় স্টলে তারা আমিষ খাবার রাখতে দেবে না। এই সময় মাংসের দোকান বন্ধ করে দেওয়ার জন্য হুমকিও দেওয়া হচ্ছে. মুসলিমদের থেকে হামলার অভিমুখ এবার ধর্মনির্বিশেষে বাঙালিদের খাদ্যাভ্যাসের ওপরে, সংস্কৃতির ওপরে। সাম্প্রদায়িকতার বিপদ এখানেই, তা কোনও উদারতা বা সহনশীলতা শেখায় না। অপরের সংস্কৃতির প্রতি বিদ্বেষ জাগিয়েআধিপত্য কায়েম করতে শেখায়।

খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখার কিংবা পোশাক বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত অধিকার। মাছ বাঙালিদের শুধু খাদ্য নয়, বাঙালির সংস্কৃতিরও প্রতীক। পরিকল্পিতভাবে তাকে হেনস্থা করা কিংবা অপমান করার পিছনে আরএসএস-বিজেপির স্পষ্ট ইন্ধন বুঝিয়ে দিচ্ছে বিপদটা অন্যত্র।