বরুণ দাস
কথায় আছে, ভাঙবে তবু মচকাবে না৷ বাংলার সিপিআই(এম)-এর এখনকার অবস্থাটাও যেন ঠিক তেমনই৷ তাঁরা নিজেদের নেওয়া অবস্থান থেকে কখনও সরে আসবেন না৷ মহামান্য পলিটবু্যরো কিংবা সেন্ট্রাল কমিটির কথা নাহয় বাদই দেওয়া গেল, রাজ্য বা সম্পাদকমণ্ডলীর কমিটিতে কোনও পর্যালোচনা কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তা বদলাবে না৷ তা সর্বাংশে ভুল থাকলেও৷ আলিমুদ্দিনের ঘেরাটোপে বিজ্ঞান-ভিত্তিক মতবাদের স্বঘোষিত এই দাবিদারদের এমন অবৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার কোনও তুলনা হয় না৷
এতকাল তারা নির্বাচনী বিপর্যয়ের জন্য যাবতীয় দায়ভার সরাসরি চাপিয়ে দিতেন মাননীয় নির্বাচকমণ্ডলীর ঘাড়ে৷ তারা অর্থাৎ নির্বাচকমণ্ডলী ভুল বুঝেছেন৷ তাই ভুল দলকে নিজেদের মূল্যবান ভোটটি দিয়েছেন৷ তাঁরা নিজেদের ভুল যখন বুঝতে পারবেন, তখন ফিরে আসবেন তাঁদেরই দিকে৷ অতএব পার্টি-কমরেডদের আপাতত কিছু করার নেই৷ যা কিছু করার তা ভোটার বা ‘আপাত বিপথগামী’ সমর্থকেরাই করবেন৷ এই আশায় বুক বেঁধে তাঁরা পরবর্তী নির্বাচনের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকতেন৷
কিন্ত্ত ভোটার বা সমর্থকরা পরের বারও যখন একই ‘ভুল’ করলেন, অর্থাৎ ভুল দলকে নির্বাচিত করলেন নিজেদের শুধরে নেবেন৷ অর্থাৎ নির্বাচনে ভরাডুবি বা পরাজয়ের পিছনে তাঁদের কোনও দোষ-ত্রুটি নেই৷ যা কিছু দোষ-ত্রুটি তা সবটাই ‘নির্বোধ’ নির্বাচকমণ্ডলীর৷ শাসকের কোনও ভুল থাকতে পারে না৷ বিশেষ করে সেই শাসককুল যদি সিপিআই(এম)-এর মতো কোনও বামপন্থী দল হয়৷
একটানা দীর্ঘ ৩৪ বছর নিরঙ্কুশ শাসনক্ষমতায় থাকার নির্বিকল্প দম্ভ বা অহংকার তাদেরকে ঠিক এভাবেই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল৷ কিছুতেই সেই ঘোর বা আচ্ছন্নতা থেকে বাইরে বেরোতে পারছিলেন না ক্ষমতাচু্যত মাননীয় কমরেডরা৷ এমনকি, প্রকাশ্যে তাঁদের অনেকের মুখ থেকে এমন মন্তব্যও করতে শোনা গিয়েছে যে, আসলে বাম আমলে পেয়ে পেয়ে প্রান্তিক মানুষের লোভ বেড়ে গিয়েছে৷ এখন ভাবছে, যদি অন্যদল থেকে আরও বেশি কিছু পাওয়া যায়৷ এখন তো আবার শ্রী-সাথী-ভান্ডারের কতো না ছড়াছড়ি৷
বাংলার আপামর জনগণকে ঠিক এভাবেই মূল্যায়ন করে চলেছিল সিপিআই(এম)৷ অন্য দলের দিকে ঝুঁকে পড়া মানুষকে চূড়ান্ত অবজ্ঞা ও হেয় করার এক সর্বনাশী ইচ্ছা তাঁদেরকে পেয়ে বসেছিল৷ নিজেদের কৃতকর্মের দিকে কখনও আঙুল তোলার কথা মনে হয়নি৷ নির্বাচনে ব্যর্থতার পর প্রতিবারই আত্মবিশ্লেষণের আড়ালে আলিমুদ্দিনে বসে তামাম ভোটারদের ‘বিপথগামী’ হিসেবে দেগে দিয়েছেন৷ আর নিজেদেরকে নির্দোষ হিসেবে প্রতিপন্ন করেছেন৷
কিন্ত্ত মুশকিল হল, অন্যদেরকে দোষারোপ করে তো আর নিজেদের ভোট বাড়ে না৷ ফলে তাঁদের নির্বাচনী ঝুলিতে যে বড় আকারের শূন্যস্থান দেখা দিয়েছিল, তা আর কিছুতেই পূরণ হচ্ছিল না৷ মিথ্যে গোঁজামিল দিয়ে আর কতদিন চালানো যায়? ফলে গোপন ঝোলা থেকে একদিন-না-একদিন বেড়াল বেরিয়েই পড়ে এবং পড়েছেও৷ বিশেষ করে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের পর ‘গোপন কথাটি আর গোপন রহিল না’৷ তা প্রকাশ্যেই চলে এলো৷ পার্টির রাজ্য কমিটির বৈঠকে স্বীকার করে নেওয়া হল নিজেদের ব্যর্থতার কথা৷
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে ‘বুর্জোয়া’ আর ‘পুঁজিবাদের প্রতিভূ’ বা ‘দালাল’ কংগ্রেসের সঙ্গে অবাঞ্ছিত ‘লেজুড়বৃত্তি করা’র গুরুতর অপরাধে একসময় সিপিআই’কে দোষারোপ করা হতো, সেই ‘বুর্জোয়া’ আর ‘পুঁজিবাদের দালাল’ কংগ্রেসের সঙ্গেই জোট বেঁধে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে আগ-মার্কা বামপন্থী পার্টি সিপিআই(এম)৷ অতি বাম বোদ্ধারা হয়তো বলবেন, আসলে সময়ের প্রেক্ষাপটে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়৷ নীতির বদল ঘটাতে হয়৷ এটাই বামপন্থার বাস্তবতা বা মূলকথা৷ সাঁইবাড়ির ঘটনাকে প্রাধান্য দিলে হবে?
হয়তো ঠিক, আবার হয়তো নাও ঠিক৷ যদিও সবাই কমবেশি জানেন, একই সঙ্গে দুটোই কখনও ঠিক হতে পারে না৷ কিন্ত্ত আমাদের মতো অতি সাধারণ অভাবী মানুষ অতসব যুক্তিতর্ক নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না৷ আসলে মাথা ঘামানোর সময়ও তাঁরা পান না৷ কারণ ‘নুন আনতে পান্তা ফুরনো’ মানুষের তেমন অবকাশই বা কোথায়? এই সুযোগটাই নিয়ে থাকেন মতবাদ নির্বিশেষে আমাদের দেশের ধুরন্ধর রাজনীতিকরা৷ যে দেশে মৃত মানুষ নিয়ে ঘৃণ্য ‘রাজনীতি’ হয়, সেদেশের ভাগ্যে এর বেশি কিছু আদৌ হতে পারে কি?
এবার ফিরে আসা যাক মূল প্রসঙ্গে৷ সিপিআই(এম)-এর নির্বাচনী বোধোদয়৷ বারবার অভূতপূর্ব পরাজয়ের পর এবারের বিচার-বিশ্লেষণে ঠিক কী উঠে এসেছে তাদের পর্যবেক্ষণে? প্রতিবারের মতোই কি ‘নির্বোধ’ নির্বাচকমণ্ডলীর ঘাড়ে যাবতীয় দোষ চাপানোর চিরন্তন খেলা? নাকি অন্যকিছু? অনেকেরই কৌতূহল ছিল এ নিয়ে৷ কারণ বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধানোর দায় কেউ নিতে চান না৷ তার চেয়ে ‘নির্বোধ নিবাচকমণ্ডলীর ঘাড়গুলোই বরং অপেক্ষাকৃত শক্ত এবং নিরাপদ৷ অপছন্দের সবকিছু সেদিকেই ঠেলে দেওয়া সহজ হয়৷
শ্রেণি বিচ্ছিন্নতা আর বেহাল সংগটনের দিকেই এবার আহুল তুলেছেন সিপিআই(এম)-এর পোড়-খাওয়া রাজ্য নেতারা৷ লোকসভা নির্বাচনের পর আলিমুদ্দিনে অনুষ্ঠিত রাজ্য কমিটির বৈঠকে এমন সত্যকথনই ব্যক্ত করেছেন মাননীয় কমরেডগণ৷ তাঁদের বক্তব্য ছিল অনেকটা এরকম, ‘কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কাজকর্মের প্রবল সমালোচনা হয়েছে, প্রতিবাদও হয়েছে৷ কিন্ত্ত দলের শ্রেণি যোগাযোগ দুর্বল হয়ে পড়েছে৷ বুথ ও গণনা-কেন্দ্রে এজেন্ট রাখায় গুরুতর ঘাটতি থেকে গিয়েছে৷’ এবার রেহাই দেওয়া হয়েছে নির্বাচকমণ্ডলীকে৷
২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের পর শ্রেণি বিচ্ছিন্নতা এবং তৃণমূলস্তরে সংগঠনের দুর্বলতা— এই দুই কারণকেই কার্যতঃ প্রাথমিকভাবে দায়ী করেছে সিপিআই(এম) এবং পার্টি-‘পর্যবেক্ষণ’ই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে পার্টির সেন্ট্রাল কমিটির কাছে৷ গত ২৮-৩০ জুন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সেন্ট্রাল কমিটির ওই বৈঠকে তা পেশ করেন বাংলার কমরেড শ্রীদীপ ভট্টাচার্য৷ রাজ্য সিপিআই(এম)-এর রিপোর্টেই উঠে এসেছে, এবার বাংলায় ১০টি জেলা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৭ হাজার বুথে দলের পোলিং এজেন্ট ছিল না৷
অর্থাৎ গোটা রাজ্যে প্রায় ১২-১৩ শতাংশ বুথে পার্টির কোনও এজেন্টই ছিলেন না৷ আবার বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রথম দিকে পোলিং এজেন্ট থাকলেও পরে তারা বেরিয়ে আসার সেইসব বুথ থেকে সংশ্লিষ্ট ১৭(সি) ফর্ম দলের কাছে আসেনি৷ তাই পোলিং এজেন্টদের ভূমিকা নিয়ে বিশেষ পর্যালোচনার কথা বলেছেন পার্টি নেতৃত্ব৷ এবার ‘বলির পাঁঠা’ খোঁজা হচ্ছে৷ ‘পুরনো পাঁঠা’য় আর কাজ হচ্ছে না৷ তাই এবার ‘নতুন পাঁঠা’ খোঁজার চেষ্টা আর কী৷ এভাবেই অভিজ্ঞ পার্টি-নেতৃত্ব নিজেদের ঘাড় থেকে ত্রুটি-বিচু্যতি হয়তো ঝেড়ে ফেলবেন৷
এছাড়া পার্টির এমনই বেহাল অবস্থা যে, বহুক্ষেত্রে স্থানীয় স্তরে নেতৃত্বের কেউ গণনাকেন্দ্রেও যাননি৷ আবার এমনও দেখা গিয়েছে, বহু আগে থেকে আলোচনা, নির্দেশিকা, সব থাকা সত্ত্বেও বুথ কমিটিই ঠিক মতো তৈরি করা হয়নি, যা সিপিআই(এম)-এর মতো সংগঠিত পার্টির ক্ষেত্রে কল্পনাও করা যায় না৷ বুথ কমিটি না থাকায় ‘ভোটের দিনের পরিস্থিতি কাজে লাগাতে’ দল ব্যর্থ হয়েছে বলে রাজ্য কমিটির নির্বাচনী পর্যালোচনায় উঠে এসেছে৷ সেন্ট্রাল কমিটির নয়া পরামর্শ, নেতৃত্ব-সহ পার্টির সমস্ত সদস্যকে জনগণের অভ্যন্তরে যেতে হবে৷
এখানেই শেষ নয়৷ সেন্ট্রাল কমিটির আরও পরামর্শ, শুধু পার্টি অফিসের মধ্যে সারাদিন নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ না রেখে নিজেদের এলাকায়, সাধারণ জনগণের মধ্যে বেশি সময় ব্যয় করতে হবে৷ তাদের দৈনন্দিন সমস্যার দিকে নজর দিতে হবে৷ প্রয়োজনে তাদের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়াতে হবে৷ আর শ্রেণি বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠতে শ্রমিক কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংগঠনের সক্রিয়তা আরও বেশি করে বাড়াতে হবে৷ এই অর্বাচীন কলামচির মতে আরও একটি বিষয়ে সিপিআই(এম)-এর গুরুত্ব দেওয়া বিশেষ প্রয়োজন বলে মনে হয়৷
তা হল, জেএনইউ থেকে এসে যারা সরাসরি নির্বাচনে লড়ছেন, তাদেরকে আগে গ্রামে পাঠাতে হবে৷ মাটি ও মানুষের সোদা গন্ধ তাদের নিতে হবে৷ তা না হলে দেশটাকে আদতে চিনতেই পারবেন না মেধাবী কমরেডরা৷ কোন শ্রেণির মানুষ এখানে বেশি এবং কীভাবে তাঁদের জীবন কাটে, সে সম্বন্ধে বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকলে তাঁরা বামপন্থী রাজনীতি করবেন কীভাবে‘ মানুষই বা তাঁদেরকে নেবেন কীভাবে? সিপিআইএমএল(লিবারেশন)-এর সম্পাদক বিনোদ মিশ্র একবার বলেছিলেন, দেশের কাজ করার জন্য ডিগ্রি লাগে না৷
বলা বাহুল্য, নির্বাচনের আগে পার্টির শাখা সংগঠন ডিওয়াইএফআই-এর আগ্রাসী রাজ্যনেত্রী কমরেড মীনাক্ষী মুখার্জির নেতৃত্বে ‘ইনসাফ যাত্রা’ রাজ্যজুড়ে বেশ সাড়া ফেলেছিল৷ ‘ইনসাফ যাত্রা’ শেষে ব্রিগেডের জমায়েতেও বহু মানুষ যোগ দিয়েছিলেন৷ এছাড়া এবার পার্টির নির্বাচনী প্রচারেও অনেক মানুষ ভিড় করেছিলেন৷ অনেকেই ভেবেছিলেন, সিপিআইএমের মিটিং-মিছিল, রোড শোয়ে ভিড় করে আসা এই মানুষগুলোর ভোট পেলে লোকসভায় পার্টির লাগাতর খরা কাটবে নিশ্চিত৷ কিন্ত্ত সে আশা পূরণ হয়নি সিপিআইএমের৷
রামধনুর মতোই মিলিয়ে গিয়েছে সিপিআইএমের সে আশা৷ ফলে নিজেদেরকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতোই সিপিআইএমকে এখন উচ্চারণ করতে হচ্ছে ‘দেশ ও রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিজেপির শক্তি কমানোর ডাক দিয়েছিল সিপিআইএম৷ জনতার বড় অংশ তা গ্রহণ করেছেন৷’ কিন্ত্ত বাস্তব তো অন্য কথা বলছে কমরেড৷ বিজেপির শক্তি ধাক্কা খেয়েছে তো তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে৷ সিপিআইএমের কাছে নয়৷ যেভাবেই হোক না কেন, বিজেপির ‘বিজয়রথ’ মাত্র ১২-তেই আটকে দিয়েছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস৷
পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি অবশ্য খুশি নন সিপিআইএম রাজ্য কমিটির এই অপরিসর রিপোর্টে৷ রাজ্যের সিপিআইএমকে তারা আরও বিশদে নির্বাচনী বিপর্যয়ের অন্যান্য কারণও খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং একইসঙ্গে আগামী দিনে দলের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাব্য উপায়ও খুঁজতে বলেছেন৷ এখন দেখার, এ কাজে রাজ্যের সিপিআইএম কতটা আগ্রহ দেখায়৷ কারণ এ কাজে কেঁচো খুঁজতে কেউটে বেরিয়ে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি৷ যা রাজ্য নেতৃত্বের অনেকের কাছেই অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে৷ তাই আশঙ্কা জাগে৷