শ্যামল ভট্টাচার্য
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আরজি করের জুনিয়র ডাক্তারদের এখন কাজে যোগ দিতে হবে। আদালত স্বীকার করে নিয়েছে যে, এই ঘটনা নিন্দনীয়, দুর্বিষহ ও নাড়া দেওয়ার মতো। আদালতের কাছে এটাও স্পষ্ট যে প্রথম দিকে পুলিশ ও প্রশাসন এটাকে আড়াল করার চেষ্টা করেছিল। শেষ পর্যন্ত তা না করতে পেরে বিপাকে পড়েছে। ঘটনার প্রতিবাদে জনরোষ তৈরি হয়। হাজারে হাজারে সাধারণ মানুষ বিশেষত মেয়েরা রাস্তায় নেমে আসেন। আওয়াজ ওঠে, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’।
লক্ষণীয় হল, এই আন্দোলন এখনও মূলত শহরের মধ্যবিত্তের আন্দোলন। শহর বলতে শুধু কলকাতা বলছি না। শহরাঞ্চলে যে মেয়েরা কাজে বের হন, তাঁদের মধ্যে এক তীব্র নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরী হয়েছে। পাশাপাশি ১৪ আগস্ট রাতেই এক জনজাতি তরুণীর ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় সমাজ কিন্তু একইভাবে সাড়া দেয়নি।
এখনও পর্যন্ত সব আন্দোলনই শুধু নির্যাতিতার ওপর হওয়া ধর্ষণ আর হত্যার শাস্তি চাওয়াতেই সীমাবদ্ধ আছে। নারীর ওপর অত্যাচার, এই ন্যারেটিভই আপাতত প্রধান। এবং ‘নারীবাদী’রা তো বটেই, কোনও বামদলের সমর্থকদেরও এর বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে না।
আমাদের চোখের সামনে ২০০৪ সালে মণিপুরের মনোরমা- ধর্ষণ এবং নৃশংসভাবে খুন, দিল্লীর নির্ভয়া কাণ্ড, কাশ্মীরের বাচ্চা মেয়ে আসিফা, হাথরস, কামদুনির পড়ুয়া মেয়েটির উদাহরণ রয়েছে। সর্বশেষ সংযোজন আরজি করের ডাক্তার মেয়েটি। আমাদের বিবশ হয়ে যাওয়া সামাজিক বোধকে এই মৃতদের অনুক্ত প্রশ্ন কি একবারও বিদ্ধ করছে না? কেন শুধুমাত্র নারী হওয়ার জন্য একজন মানুষকে অতিরিক্ত সুরক্ষা দিতে হবে? কিসের সুরক্ষা? তার দেহের এবং জীবনের সুরক্ষা? কেন এই ‘পবিত্র’ পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত সমাজ তার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে ব্যর্থ হবে বারংবার? উত্তর দিতে হবে, কেন তাঁদের বেলাতেই কেবল সুরক্ষার প্রসঙ্গ আসবে?
এক্ষেত্রে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ ও নেটিজেনদের দাবিগুলি প্রণিধানযোগ্য:
১) আর. জি. কর কাণ্ডে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নাতীতভাবে ন্যক্কারজনক। এর দায় নিয়ে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
২) তদন্ত ত্বরান্বিত করতে হবে। সিবিআই-এর ভূমিকা যেন যথাযথ হয়।
৩) নাইট ডিউটি বাতিল নয়, সঠিকভাবে নারী সুরক্ষার দায় রাজ্য প্রশাসনকে নিতে হবে। মেয়েদের নাইট শিফট প্রয়োজনে না দেওয়ার যে কথা সরকারি তরফে বলা হয়েছে তা প্রত্যাহার করতে হবে।
৪) এই ঘটনায় সরকার ও কর্তৃপক্ষে দায়ী কারা, তা প্রকাশ্যে এনে সরাসরি পদক্ষেপ করতে হবে।
৫) প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিশাখা গাইডলাইন মেনে আইসিসি গঠন করতে হবে, যাতে যৌন হেনস্থার সঠিক বিচার হয়। ৬) মহানগর ও বড়ো শহরগুলিতে সারারাত সরকারি গণপরিবহণ চালু রাখতে হবে।
৭) ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, উত্যক্ত করা বা যে কোনও নারীনির্যাতনের ক্ষেত্রে প্রকাশ্য ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’ ও তার প্রচারকে আইনি অপরাধের আওতায় আনতে হবে।
এটা মানতেই হবে যে, ন্যায় ও সাম্যের প্রশ্নে চলমান আন্দোলন সমাজের মানসিকতার বড় উত্তরণ! এটা একটা বড় পাওনা! কিন্তু তারপর? কে জানে কোথায় শেষ হবে এই আন্দোলন? এর পরিণাম কী? আমরা জানি, অভয়া কাণ্ডে ভারতের শহরগুলো কাঁপিয়ে দেওয়া আন্দোলনের ক্ষীর খেয়েছে এমন একটি রাজনৈতিক দল, যারা গঠনগতভাবে নারীর অধিকারের বিরোধী। যাদের থিংক ট্যাঙ্ক সংগঠনে নারীর স্থান নগণ্য।
শুধু তাই নয়, এই ধরনের প্রতিটি ঘটনায় মহিলাদের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রের কড়া আইন হয়েছে, তাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা বেড়েছে, অপরাধ কমেনি। এনকাউন্টার করে মেরে দেওয়ার পক্ষেও কেউ কেউ সওয়াল করেছেন। আমি মনে করি, শুধুমাত্র ‘নারীবাদী’ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখার ফলে ঐ গণবিক্ষোভকে রাষ্ট্র আত্মসাৎ করে নিতে পেরেছে, তথাকথিত রাষ্ট্রবাদীরা আরও বলীয়ান হয়েছে।
অথচ ঘটনাপরম্পরা কী দেখায়? কেন, কোন্ স্বার্থে স্বাস্থ্যকর্তারা এবং পুলিশ প্রশাসন, এটাকে আত্মহত্যা বলে চালাতে চেয়েছিল? হাসপাতালে হাসপাতালে চালু ঘুঘুর বাসা বাঁচাতে? কেন একজন ডাক্তারকে টানা ছত্রিশ ঘন্টা ডিউটি করতে হয়? যে দুর্নীতিচক্রের কথা সংবাদে প্রকাশ পেয়েছে, তা আসলে কর্পোরেট-স্বাস্থ্যকর্তা-প্রশা
আমরা জানি, ঘুঘুর বাসা সমস্ত আমলেই শাসক দলের প্রিয়পাত্ররা নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এই ঘুঘুর বাসা ভাঙার নামে যাঁরা এই সম্ভাবনাময় আন্দোলনটিকে ‘একদফা’ দাবিতে আবদ্ধ করে ভাবছেন, সুদিন ফিরবে আবার, জেনে রাখুন সে গুড়ে বালি, গোটা ক্ষীরটাই খেয়ে নেবে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল।
সেই আত্মসমর্পণের পথ তৈরী চলছে। সাম্প্রতিক অতীতে সিবিআইয়ের ট্র্যাক রেকর্ডও তেমন উজ্জ্বল নয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে দেশজোড়া টাস্ক ফোর্স গঠনও সেই ইঙ্গিতই বহন করে, আরও বেশি কেন্দ্রীভবন, আরও বেশি কঠোর আইনের নামে রাষ্ট্রের ক্ষমতাবৃদ্ধি, রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ; যেমনটা ইতিমধ্যেই সর্বভারতীয় মেডিকেল পরীক্ষার মাধ্যমে করা হয়েছে।
ফার্মাসিউটিকাল লবি ভীষণ শক্তিশালী একটি গোষ্ঠী, কোভিড কালে ফার্মা লবি আরও শক্তিশালী গোষ্ঠী হিসেবে সামনে এসেছে। বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে তাঁদের ইচ্ছামত স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে সাজিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে।
এখন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আরজি কর হাসপাতালের সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের বিরুদ্ধে কোনওরকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা যাতে না নেওয়া হয় সেই নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। সেজন্যে আমার মতে, অসংখ্য গরিব রোগীর কষ্টের কথা মাথায় রেখে চিকিৎসকদের যেমন দ্রুত কাজে যোগ দেওয়া উচিত, তেমনি নির্যাতিত ও নিহত চিকিৎসকের হত্যাকারী ও সংশ্লিষ্ট সকলে যাতে শাস্তি পায় তা সুনিশ্চিত করার জন্য আন্দোলনও চালিয়ে যেতে হবে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উপরোল্লিখিত দুর্নীতিগুলির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। চিকিৎসকরা এবার শুধু অফটাইমে আন্দোলনে যোগ দিন। তাহলে জনগণকে এই আন্দোলনে সঙ্গে পাবেন।
মনে রাখবেন, আমাদের সমাজে মেয়েরা শুধু ধর্ষিত বা নির্যাতিত নয়, বরং অনেক বেশি করে তাঁরা নির্লজ্জ শোষণের শিকার। পুরনো নিপীড়নের কাঠামোটারও মূল কাজ হল এই সস্তার নারীশ্রমিক বাহিনীর জোগান দেওয়া, এমনকি স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও। লক্ষ লক্ষ অঙ্গনওয়াড়ি, আশা, মিড-ডে মিল কর্মী তার উদাহরণ। জনতার পবিত্র ক্ষোভের যে বিস্ফোরণ ১৪ আগস্ট রাতে দেখা গেছে, তাকে তাই দিশাহারা হতে দেওয়া চলবে না। নারীবাদীরা, বাম বলে পরিচিতরা কি একটু তলিয়ে ভাববেন?